Monday, April 22, 2013

ভূমি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমিকেন্দ্রীক সমস্যা ও করণীয়


মির্জা মোঃ আজিম হায়দার
উন্নয়ন কর্মী

১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ত্ব আইনের ৯৭ ধারা বলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধারায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম উলেস্নখ করা হয়েছে। এছাড়াও বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে বসবাসরত প্রায় ৪৫ টির মত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অসিত্মত্ব খুজে পাওয়া যায়। এই জনগোষ্ঠীর কোন কোনটির অসিত্মত্ত্ব প্রায় বিলিন হতে চলেছে। বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য কোথাও নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসসহ তাদের জীবনের হারানো অনেক জানা-অজানা বিষয় এর পাশাপাশি বইটিতে ভূমি বিষয়ক তথ্য সম্পৃক্ত করা হয়েছে যা আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন এবং আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও সমৃদ্ধ করবে।
 বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতে কোন না কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে বসবাস করে সর্বাধিক সংখ্যক সমতলের আদিবাসী। ঢাকা বিভাগের টাংগাইল, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলাতেও রয়েছে আদিবাসীদের বসবাস। আদিবাসীদের বিভিন্ন গ্রামের আদিবাসী সম্পর্কে জীবন জীবিকা, সংস্কৃতি, ইতিহাস বিষয়ক নানা তথ্য সংগ্রহের সাথে সাথে ভূমি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এক্ষত্রে ভূমি সংক্রামত্ম সমস্যা, সমস্যার কারণ এবং সমস্যা সমাধানে করণীয় বিষয়গুলো তাদের সাথে আলোচনা করা হয়।

তথ্য সংগ্রহ করার সময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আদিবাসীদের সাথে কথা বলা হয়। এর মধ্যে বিশেষ ভাবে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- মুন্ডা/পাহান, উরাঁও, সাঁওতাল, মাহালী, বাগদি, রাজবংশী, মাহাতো, পাত্র, খাসিয়া, ভূমিজ, রায়, রবিদাস, ভূঁইয়া, কর্মকার, রাজোয়াড়, কোল, কোচ, তুরী, মুসহর, মালো, বসাক/বড়াইক, রাখাইন, তেলী, ঘটমাঝি/পাটনী, পাহাড়ী, মলিস্নক, গারো, হাজং এবং কোঁচ সম্প্রদায় ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উলেস্নখযোগ্য। বাংলাদেশের সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, উঁরাও, গারো, হাজং, মাহাতো (কর্মী) এবং মুন্ডা/পাহান সম্প্রদায়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়।
 এক সময় বেশীর ভাগ আদিবাসীর প্রধান পেশা ছিল কৃষি কাজ। কৃষিকাজ ছাড়াও তারা কৃষিজাত কুটির শিল্প, মাছধরা, শিকার, ক্ষুদ্র ব্যবসা, দিনমজুরী প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত ছিল। শ্রমিকের মধ্যে কৃষি মজুরী, বাঁশ ও বেঁতের কাজ, ধান কুড়ানো, কুলীর কাজ করা অন্যতম। এছাড়াও তারা মাছ ধরা, পশু ও কচ্ছপ শিকার, শামুক ও ঝিনুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করত তারা। আদিবাসী সেলুন, স্বর্ণকারের দোকান, চুন, হাঁস-মুরগীর খামার, দর্জীর দোকান প্রভৃতি ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত। কিছু সংখ্যক আদিবাসী রিকশা ও রিকশা ভ্যান চালনা, চাকুরী, মুচি, কাঠের কাজসহ বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত। আদিবাসীরা যাযাবরের মত জীবন যাপন না করলেও তাদেরকে প্রয়োজনের তাগিদে বিশেষ করে খাদ্যের সন্ধানে, পশু শিকারে, প্রকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় বা তৎকালীন ভারতের এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে বসতী স্থাপন করতে হয়েছে। তাই তাদের স্থায়ী জমি ও আবাসনের ক্ষত্রে সকল সময় চিমত্মা করতে হয়েছে। যাদের সাথে কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বেশী আদিবাসী পরিবারের নিজস্ব কোন জমি নাই। কোন কেত ক্ষত্রে দেখা গেছে তাদের বসত বাড়িও নাই। গারো, খাসিয়া, পাত্র এবং মনিপুরী জনগোষ্ঠী সাধারণত খাস জমি, বন বিভাগের গেজেটের জমি, অথবা অন্যের জমিতে বসবাস করছে। আলোচনা থেকে জানা যায় যে ১৯৫৬-৬২ সালের এসএ রেকর্ড-এর পূর্বে এদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে অনেকের জমির পরিমান ছিল বৃহৎ পরিবারের মত। কিন্তু বর্তমানে সেটা কমে এখন আর বৃহৎ আদিবাসী পরিবার চোখে পরে না।
ক্ষামত্মরে এসএ রেকর্ড বা ১৯৬২ সালের পূর্বের তুলনায় বর্তমানে ভূমিহীন এবং প্রামিত্মক ও ক্ষুদ্র ভূমি মালিক আদিবাসী পরিবারের/খানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি আদিবাসীদের প্রধান পেশা হলেও আদিবাসীদের কৃষি জমির মালিকানা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। আদিবাসীদের মালিকানাধীন বাগান ও পুকুরের পরিমাণ খুবই সীমিতি। কৃষি জমির মালিক আদিবাসীরা নিজেরাই নিজেদের জমি চাষাবাদ করেন। অর্থের প্রয়োজনে জমি বন্ধক/ লীজ দিয়েছেন এবং লীজের জন্য তেমন কোন ডকুমেন্ট বা সরকারি নিয়ম না জানার কারণে তাদের কাছে কোন প্রমাণপত্র নাই। কিছু কিছু পরিবার জমি বর্গা দিলেও তার কোন ডকুমেন্ট/কাগজ তারা সংরক্ষণ করছে না। এরজন্যই বেশীরভাগ  আদিবাসীদের জমি জাল দলিলের মাধ্যমে হাতছাড়া হয়েছে।
 ভূমিহীন আদিবাসীরা অন্যের মালিকানাধীন জমি যেমন; ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, সরকারি খাসজমি, খাস জলাশয়, চা বাগানের জমি, বনবিভাগের জমি, রেলওয়ের জমি, সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি, অর্পিত সম্পত্তি যথাযথ কর্তৃপক্ষর অনুমতি নিয়ে আবার বিনা অনুমতিতে বসতভিটা হিসেবে ও কৃষিকাজে ব্যবহার করছেন। কারণ এই সম্পত্তি যথাযথ কর্তৃপক্ষ তাদের কাজে না লাগিয়ে ফেলে রাখে। আদিবাসীরা নির্ঝঞ্জাট ও সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যসত্ম হলেও ভূমিকে কেন্দ্র করে তাদের নানা ধরণের জটিলতা ও বিরোধের মুখোমুখী হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মূলতঃ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ-আদিবাসীদের দ্বারা আদিবাসীদের জমি আত্মসাতের কারণে ভূমি বিরোধ দেখা দিচ্ছে। কোন কোন ক্ষত্রে আদিবাসীদের নিজেদের মাঝেও ভূমি বিরোধ দেখা দিচ্ছে। জমি দখলে আছে কিন্তু  দলিলপত্র না থাকা, দলিলপত্র থাকা সত্ত্বেও  জমি দখলে না থাকা, জোরপূর্বক জমি থেকে উচ্ছেদ করা, জালিয়াতি/ প্রতারণাকে ভূমি বিরোধের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় ফেলে তাদের হয়রানী করা হয়। ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের এলাকা/ পাড়া থেকে বিতারিত এমনকি দেশ ত্যাগেরে মত ঘটনাও নিরবে নিভৃতে ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। এলাকা থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং আদিবাসীদের দেশ ত্যাগ করার তথ্য প্রদান করেছে যাদের সাথে কথা বলা হয়েছে সেই সকল আদিবাসীগণ।
 আদিবাসীরা ভূমি সংক্রামত্ম বিরোধ মোকাবেলায় বিশেষ করে ভূমি মালিকানা রক্ষায় আদালতে এবং স্থানীয় পর্যায়ে মামলা মোকদ্দমা ও অভিযোগ দায়ের করে থাকে। ভূমি বিরোধ থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য আদালত এবং স্থানীয় পর্যায়ে মামলা এবং অভিযোগ দায়ের করেছেন। এক্ষত্রে আদালতে মামলা করার হার স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোগ দায়েরের চেয়ে অনেক বেশী। কোন কোন স্থানে দেখা যায় যে আদিবাসীদের নামে সরকারী বন্দোবস্থকৃত জমি বিনা পারমিশনে বিক্রি/ক্রয় করে দখলে নিয়ে খাচ্ছে বাঙ্গালীরা যা ৯৭ ধারার বিধান মতে কোন অবস্থাতেই সঠিক নয়। আবার আদিবাসীদের জমি অর্পিত সম্পত্তি তালিকায় গেলে সেগুলো দখলে রেখেছে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী। এই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।
 এখনো কোন কোন এলাকায় আদিবাসীরা আদিকাল থেকেই ভূমির যৌথ/সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী এবং ভূমিকে যৌথভাবে ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমান ভূমি ব্যবস্থাপনায় যৌথ ভূমি মালিকানার চেয়ে ভূমির ব্যক্তি মালিকানা কেন্দ্রিক রেকর্ডের কারণে কিছু কিছু জমি আদিবাসীদেরও এই ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। অবশ্য এখনও আদিবাসীদের যৌথ মালিকানায় জাহেরথান, মন্দির, প্যাগোডা, আশ্রম, কবরস্থান, শশ্মাণ  প্রভৃতি সম্পদ আছে। এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য একটি স্থান তারা যৌথভাবে ব্যবহার করে থাকে।
 শুধু আদিবাসীদের ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি নয়, তাদের যৌথ/সামাজিক মালিকানাধীন সম্পত্তিও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মন্দির, প্যাগোডা প্রভৃতি ধর্মীয় স্থান এবং শশ্মাণ ও কবরস্থান বেদখল হওয়ার ঘটনাও বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে। যৌথ/সামাজিক মালিকানাধীন সম্পত্তি নিয়ে মারামারি ও মামলা দায়ের হওয়ার তথ্য প্রদান করেছেন তথ্য পদানকারীরা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায়।
 আদিবাসীরা ব্যক্তির নামে জমির দলিল করার নিয়মকানুন সম্পর্কে না জানা এবং ভূমি বিষয়ক কাজে  অফিস ও কাচারিতে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা তাদের ছিলনা বলে অনেকের সমস্যা হয়েছে। যদিও আদিবাসীরা বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় ভূমি মালিকানা পদ্ধতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। ভূমি অফিসের অসহযোগিতার কারণে নিয়মিতভাবে ভূমি রাজস্ব প্রদান করতে তারা ভয়পায়। তাই তারা তাদের রাজস্ব প্রদান করতে যায় না। আদিবাসী ভূমি মালিকের ভূমি রাজস্ব হালনাগাদ করার ক্ষত্রে তেমন আগ্রহী নয়। কারণ হিসেবে দেখা যায় যে, তহসিল অফিসের সহযোগিতা তারা সহজে পায় না অথবা তারা সেখানে যেতে ভয় পায়। হাল নাগাদ করার ক্ষত্রে বিভিন্ন প্রকার ডকুমেন্ট চাওয়ার কারণে তারা আরো বেশী ভয় পায়। কোন কোন ক্ষত্রে দেখা গেছে পদবীর পরিবর্তনের ফলে তাদের সম্পত্তি মিউটেশনের ক্ষত্রে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
 আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক কম। তার উপর ভূমি বিষয়ক কোন সমস্যার পড়লে তারা শিক্ষত আদিবাসীদের সহায়তা খুব কমই পান। কোন কোন আদিবাসী ভূমি রেজিস্ট্রেশন (সংশোধন) আইন-২০০৫ পাশ হওয়া সম্পর্কে অবহিত আছেন। তবে বেশীর ভাগ আদিবাসী এই আইন কিছুই জানে না। এছাড়াও আদিবাসীদের সম্পত্তি পারমিশন নিয়ে বিক্রি করতে হয়। সেখানেও পারমিশন নিতে গেলে অনেক সময় লাগে এবং হয়রানীর স্বীকার হতে হয়। এই আইন গুলো আরো সহজ করা হলে তারা অনেক কম হয়রানীর স্বীকার হবে। আমাদের দেশের কোন নীতিমালা প্রণয়নের সময় আদিবাসীসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়টিকে আমলে নেওয়া হয়না। এই বৈষম্য আদিবাসীদের দারিদ্র্য ও ভূমিহীনতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। যা মূলতঃ দেশের রাজনৈতিক  ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রতিফলন। ক্রমাগত  ভূমি হারানোর জন্য আদিবাসীদের প্রতি নেতিবাচক রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণকে দায়ী বলে মনে করেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলেও আদিবাসীরা জমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। আবার তাদের সরলতার সুযোগ নিচ্ছে অনেকে।
 বেশীরভাগ আদিবাসদদের বক্তব্য হচ্ছে ভূমি অফিসে গেলে তাদের ভালভঅবে সহযোগিতা করা হয় না এবং তাদের আচারণ সহজসরল আদিবাসীদের কাছে বিমাতা সুলভ মনে হয় বলে তারা বলেন। এই কারণে তারা তাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য করণীয় হিসাবে ভূমি প্রশাসনের স্থানীয় পর্যায়ের অীফস ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মনোভাবের পরিবর্তন কামনা করেন।
 ভূমি হারানোর কারণঃ আদিবাসীরা নিজেদের ভূমি হারানোর কারণ হিসেবে জালিয়াতি/প্রতারণা, অ-আদিবাসীদের দ্বারা জোরপূর্বক ভূমি দখল, আদিবাসীদের নিজেদের মাঝে সমন্বয়হীনতা ও দারিদ্র্য, সংগঠনের অভাব, ভূমি দখলকারীদের অবৈধ কার্যকলাপ সম্পর্কে আদিবাসীদের অসচেতনতা এবং ভূমি আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকাকে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়াও অ-আদিবাসীদের নিকট জমি  বন্ধক দিয়ে ফেরৎ না পাওয়া, ভূমি রাজস্ব হালনাগাদ না করা, নাম খারিজ (মিউটেশন) না করা, আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আইনের জটিলতা ইত্যাদি বিষয়কে ভূমি হারানোর জন্য দায়ী বলে মনে করেন। বন্ধকী নিয়ম নীতি মেনে বন্ধকী প্রদান না করা, অর্পিত সম্পত্তি আইনের জালে আটকা পরে, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষত্রে সহযোগতার অভাব ও এনজিও’র বেশী সুদে টাকা নেওয়া এবং মহাজনী ঋণের জালে পরে জমি হারানো। এক্ষত্রে তারা জমির মালিকানার জন্য রাষ্ট্রের আইনের চেয়েও কখনো কখনো রীতিনীতির প্রতি বেশী দূর্বল ছিল। তাই কাগজ সংরক্ষণ বিষয়টিকে গুরম্নত্ব দিত না। বিভিন্ন ভাবে চরা সুদে ঋণ নেওয়ার কারণে আদিবাসীদের সম্পত্তি হারাতে বাধ্য হচ্ছে। তারা তাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য চেষ্টা করলেও চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের সুদ এবং বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে উঠতে না পারা, মাঠে কৃষি শ্রমের অভাবের কারণে তারা তাদের সম্পত্তি হারাতে বসেছে।
 সিলেট জেলায় বসবাসরত মুন্ডা/পাহান/ভূমিজ/উাঁরাও/মাতাহো (কুর্মী)-দের সাথে আলোচনা করে যানা যায় তিন/চার পুরম্নষ যাবৎ বসবাস করলেও এই জমিগুলোর মালিকানা চা বাগানের মালিকদের হাতে। বিভিন্ন অঞ্চলের খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে গিয়েও দেখা যায় একই অবস্থা। এই পুঞ্জিতে তিন/চার পুরম্নষ যাবৎ বসবাস করেও তারা এই ভূমির মালিকানা নিতে পারে নাই। তারা এখনো সরকার/চা বাগানের মালিক/বন বিভাগের নিকট থেকে লীজ নিয়ে তারা পান, সুপারি, আনারস, লেবু ইত্যাদি চাষ করে খাচ্ছে। তিন/চার পুরম্নষ বসবাস করেও তারা এই ভূমির মালিকানা নিতে পারছে না। তাই তাদের নিজেদের কোন জমি নাই বলে যানা যায় ভূমি মালিকানা নিয়ে কথা বললে তারা কিছুই বলতে পারে না।
 মধুপুর এলাকার অবস্থা একই প্রকার তারা তিন/চার পুরম্নষ পূর্ব থেকে বসবাস করলেও বেশীর ভাগ গারো/মান্দি এবং অন্যান্য আদিবাসীদের বসবাস এলাকার জমির মালিক বন বিভাগরে। ১৯৫৫ সালে প্রথম গেজেট প্রকাশ হয়। ১৯৬২ সালে ২য় গেজেট প্রকাশ হয় যার মাধ্যমে সমসত্ম এলাকার জমির মালিকানা। এই এলাকার জমি শুধু দখলী সুত্রে মালিকানা পরিবর্তন হয় কিন্তু রাষ্ট্রের রেজিষ্ট্রেশন আইনে বিক্রি হয় না। মধুপুর এলাকার গারোদের বসবাসরত বেশীর ভাগ জমিতে। আর ও আর-এর মূলে তারা আগে খাজনা দিতে পারলেও বর্তমানে খাজনা দিতে পারছে না। আদিবাসীদের কমিউনিটি সম্পত্তি হাতছাড়া হবার কারণ হিসাবে জোড় দখলের পাশাপশি আরো একটি তথ্য পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে স্মশান এবং মন্দিরের নামে জমি তারা রেকর্ড করাতো পারে নাই বলে। স্মশান হিসাবে ব্যবহার করলেও জমিটি সরকারের খাস জমি হিসাবে থেকে যাওয়ার কারণেও অন্যের নামে বন্দোবসত্ম হয়ে থাকে এবং অন্যরা দখল করে নেয়।
 দেবত্তর সম্পত্তি বিষয়ে তারা বলেন যে, দেবত্তর সম্পত্তিগুলো বিভিন্নভাবে অবৈধ দখলদারদের কাছে আছে। তাদের নিকট থেকে উর্দ্ধার করে ভূমিহীনদের আদিবাসীদের মাঝে অস্থায়ী লীজ প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে লীজের অর্থ দেবত্তর ফান্ডে আসবে। এতে করে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে সম্পত্তি উর্দ্ধার করার মাধ্যমে দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার ক্ষত্রে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে সকলে মনে করেন। 
 পটুয়াকালী এবং বরগুনা এলাকার আদিবাসী রাখাইন জনগোষ্ঠির সাথে আলোচনা করে জানা যায় যে, তাদের এলাকার জমি হাত ছাড়া হয়েছে বিভিন্ন ভাবে- এর মধ্যে সোলে নামা, ভূয়া সোলে নামা দেখিয়ে, জাল দলিল, বিভিন্ন জন ভুয়া রেকর্ড দেখিয়ে জমি দখল, পারমিশন ছাড়া বিক্রি, গোপনে আদালতের একতরফা ডিক্রী গ্রহণ এছাড়াও এসি (ল্যান্ড) অফিসে কাগজপত্র পাওয়া যায় না, সঠিক সীমানা না রাখা।
 মধুপুর গড়াঞ্চল সম্পর্কে সংক্ষিপ্তঃ মধুপুর গড়াঞ্চলকে ১৯৬২ সালে ৪০ হাজার একর বন এলাকা নিয়ে তখনকার পাক সরকার প্রথম ‘‘জাতীয় উদ্যান’’ ঘোষনা করে। তখন হতেই মধুপুর গড়াঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে সমস্যা হয়ে আসছে। কারণ ১৯৬২ সালে তখনকার সরকার বাহাদুর যখন ‘‘জাতীয় উদ্যান’’ ঘোষনার মাধ্যমে বনের ভিতরে বসবাসরত আদিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য নোটিশ প্রদান করেন। ‘‘জাতীয় উদ্যান’’ ঘোষনা করার সময় বনের ভিতরে আদিবাসীর গারো, কোচ জনগোষ্ঠি যে বসবাস করে, এই এলাকায় যে আদিবাসী গ্রাম আছে সে বিষয়গুলো আমলে নেয় নাই। সেই সময় থেকেই বন বিভাগ তথা সরকার আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জায়গা জমি নানা কৌশলে দখল করার করে আসছে।
 ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়ে বাংলাদেশ হল। মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসীরা আশায় বুক বাধল তাদের আর এই এলাকা থেকে উচ্ছেদ হতে হবে না। কিন্তু ১৯৮২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ‘‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’’ মধুপুর গড়াঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের সাথে কোনরম্নপ আলোচনা ছাড়াই  আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা চিহ্নিত করে দ্বিতীয়বার মত ২০,৮৩৭ একর সীমানা নির্ধারন করে ‘‘জাতীয় উদ্যান’’ ঘোষনা করে। এতে আবারও অত্র এলাকায় বসবাসরত গারো, কোচসহ অন্যান্য আদিবাসী জনগণ উচ্ছেদ আতংকে আতংকিত হয়।
 মধুপুগড়াঞ্চলের ভূমির সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৬২ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে দেনদরবার করা হলেও অদ্যাবধি কোন সরকারই মধুপুর গড়াঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধান দেয়নি। অন্যদিকে দেখা যায় ১৯৭৮ সালে বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ, ১৯৮৬ সালে রাবার প্রকল্প, ১৯৮৮ সাল হতে সামাজিক বনায়ন-এর নামে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে মধুপুর গড়াঞ্চলের প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংশ করা হচ্ছে। এছাড়াও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং বাঁকীদের উচ্ছেদের পায়তারা করা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সমসত্মবনাঞ্চলের বনভূমি জবর দখল করে নিয়েছে যা আদৌ সত্য নয়। মধুপুরের গড়াঞ্চলের আদিবাসীদের পূর্বপুরম্নষেরা এই এলাকাতে ছিল, এখনো তারা সেখানেই আছে। শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাবে অথবা বনভূমিকে তারা মনে করে তাদের পূর্বপুরম্নষেরা তৎকালিন/তখনকার সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে জমি জমার কাগজপত্র করে নাই বা করার প্রয়োজন বোধ করে নাই। সচেতনতার অভাবে অথবা সরকার বাহাদুরের প্রচারের অভাবেই হয়তো তারা তাদের বসবাসরত জমিতে মালিকানার জন্য কোন কাগজ করতে যায় নাই। তারা জানত যে জমিতে দীর্ঘ দিন ধরে বাস করছে সেটা তাদের নিজেদের জমি। এর জন্য কাগজ করতে হবে সেটা তাদের তখন বোধগম্য হয় নাই।
 বর্তমানে পরিস্থিতির কারণেই মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী জনগণ তাদের জমির কাগজপত্র সংগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ শুরম্ন করেছে। ইতোমধ্যে এই এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মীগণ ‘‘আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, ভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ’’, ‘‘ভূমি সংস্কার ও ভূমি জরিপ বিষয়ক প্রশিক্ষণ’’ এবং ভূমি সংস্কার, ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ’’ গ্রহন করেছে। যতদুর জানি এই অঞ্চলে অনেকগুলো সংগঠন কাজ করছে গড়াঞ্চলের আদিবাসীদের অধিকারের লক্ষ্য তাদের মধ্যে যারা এই বিষয়গুলোর উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে- জয়েনশাহি আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ, আচিক মিচিক সোসাইটি, এসিডিএফ, আইপিডিএস, কারিতাস, সিবিএসডিপি ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উলেস্নখযোগ।
 প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মীরা ফিরে গিয়ে মধুপুরগড়াঞ্চলের ভূমির মালিকদের ভূমির মালিকানা বজায় রাখার জন্য গ্রাম চিহ্নিত করাসহ নিজ নিজ জায়গা জমির সীমানা নির্ধারন করাকে অতীব জরম্নরী বলে মনে করেছে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ‘‘আদিবাসী ক্লাষ্টার উন্নয়ন ফোরাম’’ এবং ‘‘জয়েনশাহি আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’’-এর ভূমি সংস্কার ও ভূমি জরিপ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী বর্তমানে জুয়েল রিছিল এবং কানাই ম্রং এই দু’জন গত ১৪/৪/২০১২ ইং তারিখ হতে বেরীবাইদ মৌজার মাগমত্মীনগর গ্রামে জরিপের কাজ শুরম্ন করে। জরিপ রিপোর্টে দেখা যায় এ পর্যমত্ম মোট ৮৫ পরিবারের ভূমি জরিপ করা হয়েছে। ৮৫ পরিবারে স্বত্বদখলীয় মোট জমি আছে ১৯১.০৮ একর এবং সিএস জমি আছে ০.৬০ একর সর্বমোট ১৯১.৬৮ একর জমি যা পরিবার হিসাব করলে গড়ে ২.২৫ একর মাত্র।
 দ্বিতীয় ভূমি জরিপ শুরম্ন হয় টেলকী গ্রামে গত ১১/১১/১২ইং তারিখ হতে। উক্ত জরিপ রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায় যে টেলকী গ্রামে মোট ৩৬ টা পরিবারের স্বত্বদখলীয় জমি রয়েছে মোট ৫৪.৩৮ আরওআর রেকর্ডভুক্ত জমি ১২.২৯ একর এ মিলে পারিবারিক জমি সর্বমোট ৬৬.৬৭ একর যা পরিবার হিসাব করলে গড়ে প্রতি পরিবারের মাত্র ১.৮৫ একর মাত্র। ঐ গ্রামে একটি স্কুল তথা প্রার্থনা গৃহ (গীর্জা) এর জমি আছে .৪৯ একর, টেলকী থাংচায়ানি বহুমুখী মহিলা সমিতির নামে জমি আছে .৩০ একর সর্বমোট ৬৭.৬৬ একর জমি জরিপ করা হয়েছে টেলকী গ্রামে।
 ভূমি রক্ষায় করণীয়ঃ আদিবাসীরা নিজেদের ভূমি অধিকার রক্ষা ও নিঃস্বায়ন প্রক্রিয়ার অবসানে নিজেদের সচেতনা বৃদ্ধি, নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলা, স্ব-কর্মসংস্থানের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি, ভূমি আইন সম্পর্কে ধারণা প্রদান এবং আদিবাসীদের মাঝে শিক্ষার প্রসারে  প্রতি অধিকতর গুরম্নত্ব প্রদান করেছেন। এছাড়াও আদিবাসীদের মাঝে খাসজমি বন্দোবসত্ম প্রদানে সরকার ও এনজিওদের সমন্বিত  সহায়তা প্রদান, আদিবাসীদের বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধারে আইনগত সহায়তা প্রদান এবং আদিবাসীদের জন্য গৃহীত যে কোন সরকারি বেসরকারি কার্যক্রমে আদিবাসী জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবি জানানো। আদিবাসী সংগঠনের কর্মসূচিতে ভূমি ইস্যুকে সম্পৃক্ত করে কাজ করা। আদিবাসী এলাকাতে যে সকল এনজিও কাজ করছে তাদের কর্মসূচিতে আদিবাসীদের ভূমি রক্ষায় যে সকল কর্মসূচি আছে তা সম্পৃক্ত করে কাজ করতে হবে। এছাড়াও আদিবাসী অধ্যুসিত এলাকায় সরকারী ভূমি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের আদিবাসী এবং আদিবাসীদের ভূমি আইন বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা প্রদান করতে হবে। আদিবাসী অধ্যুসিত এলাকায় কর্মরত সংগঠনগুলো/সরকারী উদ্যোগে আদিবাসীদের ভূমির সমস্যা জরিপ করতে হবে। সেই জরিপের আলোকে সমস্যার ধরণ অনুযায়ী পদক্ষপ গ্রহনের জন্য সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করে ঐ অঞ্চলে কর্মরত এনজিও-দের মাঝে সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সরকারী প্রশাসনের ইতিবাচক দৃষ্টিভংগী তৈরীর লক্ষ্য কাজ করতে হবে।
 পারিবারে নারী-পুরম্নষ উভয়কেই সম্পত্তির বিষয়ে সম্পৃক্ত করে পারিবারিক সম্পত্তি স্বচ্ছ করার ক্ষত্রে অংশীদারীত্ব প্রদানে উৎসাহিত করা। পারিবারিক, সামাজিক এবং সংগঠন পর্যায়ে নারীর সম্পত্তিতে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা। পারিবারিক সম্পত্তি রক্ষায় নারীর অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা। পিতার সম্পত্তি ছাড়া যৌথ/পরিবারের ক্রয়কৃত জমির উত্তরাধিকারের ক্ষত্রে নারীর সমান অংশীদারীত্ব নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা। অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে ভূমির সাধারণ ধারণা প্রদানে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য কাজ করা।

No comments: