Wednesday, March 27, 2013

চুনিয়া-ভুটিয়া-টেলকী-বেদুরিয়া


চুনিয়া-ভুটিয়া-টেলকী-বেদুরিয়া
সঞ্জীব দ্রং

১.
আজ জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদের ৫০ বছর পূর্তি  উৎসবের দিনে আবিমা’কে নিয়ে আমার কিছু স্মৃতির কথা বলবো। যারা লেখালেখির জগতের সঙ্গে যুক্ত, তারা নিশ্চয় কোনো না কোনোভাবে আমার লেখা পড়েছেন। আমার বইগুলোতে মধপুর বনের
কথা আছে। আমি নিজে ছিলাম খুব পড়ুয়া ছেলে। শুধু যে স্কুলের বা কলেজের পাঠ্য বই পড়তাম, তা নয়। অন্যান্য প্রচুর বই পড়তাম। উপন্যাস, গল্প ও কবিতার বই পড়তাম। আদিবাসী বিষয়ক বই বা কোনো লেখা পেলে তো কথাই নেই। এমনকি আদিবাসী বিষয়ক সিনেমা দেখতাম। এই মুহুর্তে ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আমি জেমস ক্যামেরনের ‘‘এ্যাভটার’’ ফিল্মের প্রচার চালাচ্ছি। গত ১২ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৩ আমেরিকান ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) শতাধিক ছাত্রছাত্রীর জন্য তাদের ফ্যাকাল্টিতে গিয়ে লেকচার দিলাম। এই ফ্যাকাল্টির ডিন হলেন ফিলিপাইনের অধ্যাপক ড. চার্লস সি ভিলানুয়েভা। তিনি নিজেও আরো কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের নিয়ে আমার পুরো বক্তৃতা শুনেছেন। তিনি বক্তৃতা শেষে আমার উপস্থাপনার স্টাইলকে প্রশংসা করেছেন। যেহেতু বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই ছিল বাঙালি, তাই এ্যাভটার ফিল্ম সম্পর্কে বলার আগে বক্তৃতার শুরম্নতেই আমি একটি গানের ভিডিও দেখিয়েছিলাম। গানটি মাইকেল জ্যাকসনের দি আর্থ সং। অধিকাংশ ছেলেমেয়েই এই গানটি আগে শুনেছেন এবং ভিডিওতে দেখেছেন। কিন্তু তারা আমি যেরকম ভাবি, যে চোখ হৃদয় দিয়ে গানটি অনুভব করি, সেভাবে দেখেননি। গানে আছে কেনিয়া-তাঞ্জানিয়ার মাসাই আদিবাসীদের ছবি, দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া-পেরম্ন অঞ্চলের আদিবাসী-বনবাসী মানুষের জীবনচিত্র, যারা ধরিত্রী, প্রকৃতি, বড় বড় গাছ, নানা বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্রকে সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। আর বাইরের মানুষ শক্তি দিয়ে, অস্ত্র ও ট্যাংক এনে সেই জীবনের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এটি মাইকেল জ্যাকসনের গান। গানে আছে, হুয়াট এ্যাবাউট সানরাইজ...

What about sunrise
What about rain
What about all the things
That you said we were to gain...
What about killing fields
Is there a time
What about all the things
That you said was yours and mine...
Did you ever stop to notice
All the blood we've shed before
Did you ever stop to notice
The crying Earth the weeping shores?

বাঙালি তরুন-তরুণীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভিডিওতে ওদের ক্লাশরুমে বা সেমিনার কক্ষে বসে গানটি শোনে ও ভিডিও দেখে। হলরুমের লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয় ভিডিও দেখার সুবিধার্থে। পুরো কক্ষ নীরব থাকে। ভিডিও শেষে কক্ষের আলো জ্বলে। ছেলেমেয়েরা হাততালি দেয়। আমি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে মনে মনে ভাবি, বেঁচে থাকার এরচেয়ে আনন্দ কী হতে পারে? আমি ফিরে আসি মঞ্চে। ছেলেমেয়েদের বলি, এই যে মাইকেল জ্যাকসনের মতো মানুষ গান গাইলেন যাদের নিয়ে, তারা মাসাই, তারা আইমারা আদিবাসী। গানটি দেখে যে মায়া-মমতা আপনাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে প্রকৃতি, ধরিত্রী ও মানুষের জন্য, এমন মানুষ এমন প্রকৃতি ও বন আমাদের দেশে আছে। আপনারা মেধা দিয়ে নয়, মস্তিস্ক দিয়ে নয়, হৃদয় নিয়ে অনুভব করবেন, এখানেও ওই গানটির চিত্রায়নের মতো মানুষ ও প্রকৃতি অসহায় ও বিপন্ন। ওই গানের দৃশ্যে চিত্রায়িত জলপাই জীপগুলো, স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান আর ট্যাংক হলো প্রতীকি ব্যাপার। পৃথিবীকে আমরা ধ্বংস করে চলেছি। এখানেও মধুপুরের বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক মানুষ ও রাষ্ট্রসমূহ বুঝতে পারছে না ওই লেটিশিয়া ঘোষণাপত্রের মতো,
All peoples are descendants of the forest. When the forest dies we die. We are given responsibility to maintain balance within the natural world. When any part is destroyed, all balance is cast into chaos. When the last tree is gone, and the last river is dead, the people will learn that we cannot eat gold and silver. To nurture the land is our obligation to our ancestors, who passed this to us for future generations.’ কী আবেদনময় ও গভীর কথা বলেছেন বিশ্বের আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। যেন জীবন থেকে উঠে এসেছে কথাগুলো। এর বাংলা অর্থ করা কঠিন কিছু নয়। তারা বলেছেন, ‘সকল মানুষের আগমন ঘটেছে বন থেকে, ভূমি থেকে। বন মরে গেলে মানুষ মরে যায়। আমাদের উপর দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার, একে মমতা-ভালোবাসা দিয়ে লালন করার। যখন এ প্রকৃতির কোনো একটি অংশকে ধ্বংস করা হয়, তখন সকল ভারসাম্য লন্ডভন্ড হয়ে যায়। যখন বনের শেষ বৃক্ষ কেটে ফেলা হয়, শেষ নদীটি শুকিয়ে যায়, তখন মানুষ শিখবে যে সোনা ও রূপা খেয়ে জীবন বাঁচে না। সঠিকভাবে, পরম যত্নে, নির্লোভভাবে প্রকৃতিকে, বন ও ভূমিকে ব্যবহার করার ভার আমরা পেয়েছি পূর্বপুরম্নষদের কাছ থেকে, যারা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একে রক্ষার ভার আমাদের দিয়ে গেছেন।’

বিশ্বের আধুনিক বাজার অর্থনীতির লোভী, স্বার্থপর এবং অপরিনামদর্শী রাষ্ট্রসমূহ এই কথাগুলো কানে শোনেনি, আদিবাসীদের কথা শোনেনি। রাষ্ট্রের সীমাহীন এবং ক্ষমাহীন লোভের কাছে বন-পাহাড়-নদী-প্রকৃতির আদিবাসী মানুষেরা আজ বিপন্ন, অসহায়।...

এই কথাগুলো আমি আমার লেকচারে তরুণ বন্ধুদের জন্য বলি। দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, গণস্বাস্থ্য  বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিদেশে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নরওয়ের ট্রমশো ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ডের বুরাফা ইউনিভার্সিটি, কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি আয়োজিত সেমিনারে আমি আদিবাসী জীবনের এই কথাগুলো বলার চেষ্টা করি। গত বছর অক্টোবর মাসে (২০১২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও জার্মানীর বিলেফেল্ড ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে সিনেট ভবনে ‘‘কনন্ট্রোভার্সিয়াল ডেমোক্রেটিক স্পেসেস’’ শিরোনামে একটি কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানে আমিও একটি সেশনে বক্তা ছিলাম। এই বক্তৃতার সময়েও আমি ‘‘এ্যাভটার’’ ফিল্মের উদ্ধৃতি ব্যবহার করি। পরবর্তী সময়ে আমার এই স্টাইলে অভিভূত হয়েছিলেন বাইরের কয়েকজন বিখ্যাত প্রফেসর। তাদের মধ্যে আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটির ডেভেলপমেন্ট সোশ্যালজির অধ্যাপক ড. শেলী ফেল্ডম্যান, যুক্তরাজ্যের সাসেক্স ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কেটি গার্ডেন, জার্মানীর বিলেফেল্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. যোয়ান্না পাফ অন্যতম। তারা পরবর্তী সময়ে আমার বাসায় এসেছেন ডিনার খেতে।

২.
এখন দেখি, কী কথা বা ডায়ালগ আছে এ্যাভটার ফিল্মে। ফিল্মের কাহিনী দুই পক্ষকে নিয়ে। একপক্ষ ওমাতিকায়া ন্যাটিভ আদিবাসী, যারা ওই বন, ভূমি ও বৃক্ষরাজিকে সারাজীবনের জন্য, পরবর্ত প্রজন্ম, এমনকি তারপরের প্রজন্মের জন্য এমনিভাবে রেখে যেতে চায়। ওই আদিবাসী মানুষদের কাছে সবকিছু পবিত্র। সবকিছুর প্রাণ আছে। অল ইজ কানেক্টেড। অন্যদিকে আছে স্কাই পিপল, যারা বহিরাগত। এই স্কাই পিপলদের কমান্ডার এক কর্নেল হিসাব করে বের করেছে ওই আদিবাসী অঞ্চলের একেকটি পাথর রত্নের দাম দশ মিলিয়ন ডলার। স্কাই পিপলদের কথা হলো, এত দামি জিনিস ওদের বনে থাকবে কেন? তাই সংঘাত অনিবার্য হয়। স্কাই পিপলদের দল মেশিনগান ও অত্যাধুনিক মিগ ফাইটার নিয়ে আদিবাসী ন্যাটিভদের আক্রমণ করে। সব সমাজেই যেমন কিছু ভালো মানুষ থাকে, তেমনি ছবির নায়ক প্রাক্তণ নৌ বাহিনীর অফিসার জ্যাক সুলি আদিবাসীদের পাশে এসে দাঁড়াতে চায়। প্রথমে জ্যাক সুলিকে আদিবাসীরা ধরে নিয়ে আসে। প্রথমে তাকে আদিবাসীরা সন্দেহ করে। আদিবাসী নায়িকা নিয়তিরির বাবা মি. মৌট-এর সামনে জ্যাককে হাজির করা হয়। তাদের কথোপকথন হয় এভাবে,

Moat: Why did you come to us?
Jake Sully: I came to learn.
Moat: We have tried to teach other sky people, it is hard to fill a cup which is already full.
Jake Sully: My cup is empty, trust me.

এরপর নায়িকা নিয়তিরির বাবা নায়ক জ্যাককে বলে, ঠিক আছে, আমার মেয়ে তোমাকে আমাদের জীবন ধারা শেখাবে, এতে যদি তোমার ভেতরের অশুচি জিনিস শুদ্ধ হয়।
Moat: It is decided. My daughter will teach you our ways. Learn well, "Jakesully", and we will see if your insanity can be cured.  

এরপর নায়িকা নিয়তিরি নায়ক জ্যাককে নিয়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। জ্যাক বলে,
Jake Sully: I need your help.
Neytiri: You should not be here.
Neytiri: No! Go back!
Jake Sully: Well, if I'm like a child, then look, maybe you should teach me.
Neytiri: Sky People cannot learn, you do not see.
Jake Sully: Then teach me how to see.
Neytiri: No one can teach you to see. 

 
পাঠক খেয়াল করবেন গভীরভাবে। মধুপুরের বনে বহিরাগত মানুষ, সরকার, বনবিভাগ, পুলিশ, ন্যাশনাল পার্ক, ইকো-পার্কের ঘরবাড়ি, রাসত্মাঘাট, উডলট বাগান, সামাজিক বনায়ন, এই সবকিছুতে ‘‘এই শেখার’’ সংস্কৃতি বা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কিনা। কিভাবে হলিউডের ছায়াছবি এই মধুপুরের মান্দি-কোচ-বর্মনদের জীবনের কাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়।


পরবর্তী সময়ে নায়ক-নায়িকার প্রেম হয়। তারা মিলিতি হয় বিশাল একবৃক্ষের ছায়ায়। মেয়েটি বলে,
Neytiri: I'm with you now, Jake. We are mated for life. 
Neytiri: You are Omaticaya now. You may make your bow from the wood of Home tree.

এই ছবি দেখতে দখতে এই আবিমার বনেও আমি বাইরে  থেকে এসে জীবনভর থেকে যাওয়া আমেরিকান ফাদার ইউজিন হোমরিকের জীবনের মিল দেখতে পাই। তিনি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েননি জ্যাক সুলির মতো। কিন্তু এই বনের মানুষদের ভালোবাসা ও নিরাপত্তায় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় পার করে ফেলেছেন।

৩.
আমি কতবার যে আবিমা গিয়েছি, গুণে গুণে বলতে পারবো না। তবে বলতে পারি, বেশিরভাগ সময়েই গিয়েছি নানা সমস্যা নিয়ে। আবিমার মানুষদের দুঃখ-কষ্ট-দুর্দিনের দিনেই বেশি গিয়েছি। গিদিতা রেমা হত্যা থেকে শুরম্ন করে, অধীর, বিহেন, পীরেন সণাল, চলেশ রিছিল হত্যার সময় বা পরবর্তীতে কতবার যে গিয়েছি। এখন মনে হয়, এসব লিখে রাখা উচিত ছিল। সেই সময়গুলোর ছবি ও রিপোর্ট নিশ্চয় আছে। এমনকি সিসিলিয়া নামে একটি মেয়েকে যখন ছররা গুলি করা হলো, তারপর দিনই আমি গাড়ি নিয়ে সাংবাদিকসহ সেখানে গিয়েছিলাম। সম্ভবত সে সময় সিসিলিয়া অমত্মঃসত্ত্বা ছিলেন। আজ তিনি কেমন আছেন, কে জানে। পীরেন সণালের সমত্মানেরা কেমন আছেন? চলেশ রিছিলের পরিবার ও তার মেয়ে প্রিয়াংকা কেমন আছেন? অন্য যারা নিহত ও আহত হয়েছেন, আবিমার ভূমিতে নানা সময়, তারা কেমন আছেন? আমাকে কেউ কি বলতে পারবেন, এই বনে এতসব মানবাধিকার লংঘন ও হত্যার কোনো সুষ্ঠু বিচার হয়েছে? আজ জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রশ্নগুলো আবার নতুন করে রাখলাম।

৪.
দেশের কঠিন এক সময়ে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে আমি মধুপুরে গিয়েছিলাম দুইবার। সেই সময় বহুদিন পর মধুপুর বনে আদিবাসী গারোদের মধ্যে রাত কাটিয়েছিলাম। ওদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা-সংগ্রামের কথা শোনার চেষ্টা করেছিলাম। ভালো খবরের চেয়ে দুঃখ ও হতাশার খবরই ছিল বেশি। চলেশ রিছিলের পাশের গ্রাম বেরিবাইদ থেকে এক গারো মহিলা আকুল আবেদন নিয়ে এসেছিলেন। যৌথ বাহিনীর ভয় দেখিয়ে বনবিভাগ তার এতদিনের কলাবাগান ধ্বংস করে দিয়েছিল। খুব বেশি বাগান ছিল না তার। কত আশা ছিল বাগান নিয়ে। কয়েক মাস পর কলা বিক্রি করে বছরের কিছু সময়ের খাবারের খোরাক জমাবেন, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার কিছু খরচ যোগাবেন, সংসারের অভাব সামান্য হলেও দূর করবেন। কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এ গারো মহিলার সব স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। বনবিভাগ একদিন বাঙালি শ্রমিক নিয়োগ করে তার কলাবাগান নিষ্ঠুরভাবে কেটে ফেলে রেখে গেল। এই মান্দি মহিলার মতো অসংখ্য নারী ছলছল চোখে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। লেখক মানুষ আমি কী করতে পারি। ওরা হয়তো মনে করেছিলেন আমাকে বললে কিছু সমাধান হতে পারে।  ভাবলাম, সেনাবাহিনীতে আছেন এবং আমার সঙ্গে পরিচয় আছে, এরকম কাউকে এই মান্দি মহিলার কষ্টের কথা বলা যায় কিনা। আমার কাছে গোল হয়ে বসা গারো জনগণ বলেছিলেন, দয়া করে একটু ফোন করেন, ওরাই তো এখন ÿমতাধর। আমার পরিচিত সেনা অফিসার, যাকে আমার কাছে অনেক বেশি মানবিক ও সংবেদনশীল মনে হয়েছিল, তাকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, তিনি টাঙ্গাইলে এক কর্ণেলের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপরে মান্দিদের দুঃখ কমেছিল কিনা আমি জানি না। পরদিন সকালে জলছত্র থেকে পীরগাছা রওনা হয়েছিলাম। গাছাবাড়ির পর আমলিতলা এবং ভুটিয়া গ্রামে রাসত্মার ধারের কলাবাগানগুলো তছনছ করা হয়েছিল। অনেক শ্রমিক নিয়োগ করে এই বাগানগুলো ধ্বংস করে কোথাও কোথাও সামাজিক বনায়নের নামে গাছ লাগানো হয়েছিল। সামাজিক বনায়নের কথা আমাকে গারোরা বলেছিলেন। আমি প্রকল্পের নাম জানতাম না। এটি কী রকম সামাজিক বনায়ন যা মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে, জোর করে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত অধিকৃত ভূমিতে করা হয়? আমি জেনেছিলাম, বনবিভাগ নিজে এখানের প্রাচীন শালবন ধ্বংস করে বিদেশী গাছ লাগিয়েছিল। তাতে প্রাচীন ও প্রাকৃতিক বনের মধ্যে ফাঁকা ভূমি তৈরি হয়। সেই বিদেশী গাছ কেটে ফেলার পর বনবিভাগ বাইরের লোকদের সে জমি বরাদ্দ দেয়। এভাবে বনের অনেক অংশে কলাবাগান সৃষ্টি হয়। এই সব কাহিনী শুনেছি মানুষের মুখে, আর নিজ চোখে দেখেছি কলাবাগানে ভরে গেছে বনভূমি।

৫.
চুনিয়া-পীরগাছা থেকে বিকালে ফিরে আসবার পথে ভুটিয়া গ্রামের কাছে দু’জন গারো মহিলার সঙ্গে পথে দেখা হয়েছিল। ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া তাদের কলাবাগান দেখিয়ে তারা আমাকে বলেছিলেন, আমাদের জমির কাগজ আছে। তবুও আমাদের বাগান শেষ করে দেয়া হলো। তিনি যৌথ বাহিনীকে কাগজও দেখিয়েছিলেন। পরে তিনি উদভ্রামেত্মর মতো কাগজ নিয়ে ঘুরেছেন। তার কথা শোনার তখন কেউ ছিল না।

সেদিন মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পিছনে ফিরে তাকিয়েছিলাম দোখলা, ভুটিয়া, পীরগাছা, চুনিয়া, টেলকী, বেদুরিয়ার মানুষেরা কত অসহায়। রাষ্ট্রের কত শক্তি? এক নিমিষে অনেকদিনের আদিবাসী মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। মধুপুর বনে চুনিয়া গ্রাম নিয়ে কবি রফিক আজাদ ১৯৭৫ সালে একটি কবিতা লিখেছিলেন। চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া শিরোনামে তার কবিতার কয়েকটি লাইন এরকম... চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে, বৃÿদের সাহচর্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রসত্মাবে খুব সুখে আছে। চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্য সমাজের কারম্ন কারম্ন মনে, কেউ কেউ এখনো তো পোষে বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া, চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি...।’

কবি রফিক আজাদের এ মনোরম আদিবাসী ভূমির আদি মানুষেরা সেই সময় এক হৃদয়হীন দানবের কবলে ছিল। কবির ভাষায় সেই কালে, ওরা হয়তো সুখে ছিল। আজ ওরা কেমন আছে? আগামী দিনে ওদের ভূমি মালিকানার কী দশা হবে? কিছুই তো সমাধান হলো না। সব ঝুলে আছে ওই আগের ইকো-পার্ক সময়ের ঝামেলার মতো। অনিশ্চয়তা তো দূর হলো না। সমতলের আদিবাসীদের জন্য কথা দিয়েও, নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেও তো সরকার ভূমি কমিশন গঠন করলো না।

৬.
জলছত্র বা পীরগাছায় গেছি বেশ কয়েকবার সেমিনারে কথা বলতে। ডাইওসিস যে কর্মসূচি নেয় মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট ছাত্রছাত্রীদের জন্য, সেখানেও গেছি অনেকবার। দরগাচালা গ্রাম দেখলাম এই প্রোগ্রামের সৌজন্যে। ঢাকা থেকে খুব সকালে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে বক্তৃতা করে আবার রাতে ফিরে এসেছিলাম। মাঝে মাঝে ভাবি,  কেন আমি ২ ঘন্টার লেকচারের জন্য এত কষ্ট করে, খরচ করে যোগ দিই। এসব প্রোগ্রামে আমি ছেলেমেয়েদের বলি, মান্দি তরম্নণদের অনেক দূরের পথ যেতে হবে। যাত্রা শুরম্ন করতে হবে। আর বলি, ‘গমত্মব্যে পৌঁছার চেয়ে যাত্রাপথ অনেক সুন্দর।’ কথাটি মনে রাখতে বলি। মান্দি তরম্নণদের যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হবে। মান্দি সমাজ আমাকে কী দিয়েছে বা চার্চ আমাকে কী দিয়েছে বা আবিমা আমাকে কী দিয়েছে, এরকম চিমত্মা না করে আমি কী দিতে পারি সমাজের জন্য, এরকম ভাবতে হবে। ছেলেমেয়েদের বলি, এরকম কথা বলেছিলেন জন এফ কেনেডি ১৯৬০ সালে।  
John F. Kennedy, Inaugural address, January 20, 1961


মান্দি তরম্নণ-তরম্নণীরা মন দিয়ে আমার কথা শুনেছিল। তাদের বলেছিলাম, মান্দিদের জন্য কাজ করতে হবে। অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী ছিল মধুপুরের। আশার কথা হলো, ওরা মান্দিদের সমস্যা সম্পর্কে, বিশেষত মধুপুর বনে মান্দিদের সমস্যা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে। আমরা বলি, সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলে এমনিতে নাকি অর্ধেক সমাধান হয়ে যায় বা পরে সমাধান করা যায়। ইংরেজীতে আছে, A problem clearly stated is a problem half solved.

আমি জানি না ওইসব সেমিনারে আসা ছেলেমেয়েরা কতজন ভবিষ্যতে কত দূর যেতে পারবে, সমাজের জন্য কাজ করতে পারবে। তবে তাদের আমি আশা ও সম্ভাবনার কথা বলার চেষ্টা করেছি। নতুন স্বপ্নের কথা বলেছি। বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের জেগে ওঠার কথা বলেছি। জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের কথা বলে ওদের মনে স্বপ্ন জাগাবার কথা বলেছি। সারা দেশের আদিবাসীরা যে একযোগে তাদের অধিকারের কথা উচ্চারণ করছে এবং জাতীয় পর্যায়ে কিছু কর্মসূচি পালন করছে, এ কথাগুলো বলেছি। মধুপুরের মান্দিদের সংগ্রামের কথা যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে উচ্চারিত হয়েছে এবং দিলস্নী থেকে একজন আদিবাসী চলেশ রিছিল হত্যার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে জাতিসংঘে বিলি করেছেন নিউইয়র্কে, এ কথাগুলো ওদের বলেছি। কথাগুলো বলার কারণ হলো, আমরা আদিবাসীরা এখন আগের মতো একেবারে অসহায় নই। আমাদের কথা এখন অনেক জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। কাজটা অব্যাহত রাখতে হবে।

৭.
এই কঠিন সময়েই বহুদিন পর আমি পীরগাছা গিয়েছিলাম। দূর থেকে চুনিয়া গ্রামের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছা হয়েছিল সেখানে কিছুক্ষণের জন্য যাই। যতদূর মনে পড়েছিল, বিশ বাইশ বছর আগে আমি চুনিয়া গ্রামে গিয়েছিলাম পল দারম্নর সঙ্গে। তখন তার দিদি পুতুল দারম্ন কলেজে পড়তেন আর ময়মনসিংহ শহরে কাথলিক চার্চের আয়োজনে বিচিত্রা অনুষ্ঠান হলে সেজেগুজে নাচতেন। আমরা কাচিঝুলি হোস্টেলের ‘বয়সের কারণে অতিরিক্ত উৎসুক’ ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে তার নাচ দেখতাম, দুষ্টামি করতাম। পুতুল দারম্নদের এই চুনিয়া গ্রাম নিয়েই কবি রফিক আজাদ তার বিখ্যাত কবিতা ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ লিখেছিলেন।

সেই দিন আবার বহুদিন পর চুনিয়া গ্রামের দিকে তাকিয়ে আমার ছাত্র জীবনের কথাগুলো মনে পড়েছিল। আমার ঠিক মনে নেই। আমি কি সেই সময় চুরাশি-পচাশি সালে একরাত পল দারম্নদের বাড়িতে কাটিয়েছিলাম? তখন কি মেবুল দিদি, মুকুল দিদি আরও তরম্নণ ছিলেন বয়সে? আমার তেমন মনে নেই। তাদের কি আমার কথা মনে আছে? মনে থাকার কোনো কারণ নেই।

যতদূর জানি, আজ এতদিন পর চুনিয়া অনেক বদলে গেছে। মনে মনে বলি, যদি সম্ভব হয়, কবি রফিক আজাদকে নিয়ে একদিন চুনিয়া যাওয়া দরকার। আমি বললে তিনি নিশ্চয় রাজী হবেন। পীরগাছা মিশনের আগে দোখলা। এখানে এখন বাজার বসে গেছে মনে হয়। কত দোকান। কত রকমের এন্টেনা টানানো। সম্ভবত মোবাইল ফোনের দোকান আছে কিছু। বাজারের পর ছোট ব্রিজ। চুনিয়ার দিকে তাকালে একটি পাকা ব্রিজ দেখা যায়। বিশ বছর আগে নিশ্চয় ব্রিজটি ছিল না। তখন আমরা বনের ভেতর পথ ধরে হেটেছিলাম। সেই সময়েও আমার যাওয়া হয়নি চুনিয়া। আমার সঙ্গে চারজন আমেরিকান অবলেট ফাদার ছিলেন যারা মানবাধিকারের কাজ করেন। আর সিলেটের ফাদার যোসেফ গমেজ, অবলেট। বিদেশীদের মধ্যে একজন সারা আমেরিকার অবলেট সম্প্রদায়ের মানবাধিকার কাজের প্রধান এবং একই সঙ্গে রোম অফিসেরও দায়িত্বে ছিলেন। ফাদার হোমরিক সম্পর্কে তারা জানতে আগ্রহী বিশেষ করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ফাদার হোমরিকের জীবন ও সংগ্রাম সম্পর্কে যখন লেখা ছাপা হয়েছিল, তখন থেকে। ওই লেখায় বলা হয়েছিল, ফাদার ইউজিন হোমরিক মান্দিদের ছায়ার মতো আগলে রেখেছেন বিপদে-আপদে। উনি যখন থাকবেন না তখন মান্দিদের কী হবে? মান্দিরা কি বনের অধিকার নিয়ে টিকে থাকতে পারবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি মধুপুরের মান্দি নেতাদের খুঁজতে অনুরোধ করি। ফাদার হোমরিকের মিশনে কত ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে, ভাবতেই বুক ভরে গিয়েছিল। ভাবতাম, অমত্মত এ মান্দি ছেলেমেয়েদের একটি অংশ উচ্চশিক্ষিত হবে এবং আমি বিশ্বাস করতাম, তারা একেবারে স্বার্থপর হবে না। শুধু নিজেরা উন্নতি করবে না, গ্রামের কথা, বাড়ির কথা, সমাজের কথা, পীরগাছার কথা, ছেলেবেলা এ মিশনে বড় হয়ে ওঠার কথা ওরা মনে রাখবে। নিজেরা অন্যের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবে। পরের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ নিয়ে ওরা বড় হবে। বহুদূর থেকে একজন বিদেশী ফাদার এসে তার সারাটা জীবন ঢেলে দিলেন মান্দিদের জন্য, এ কথা ভেবে এ মান্দি ছেলেমেয়েরা অনুপ্রাণিত হবে। জীবনের অন্য অর্থ খোঁজে নেবে। আমার মেয়ে অদ্রি যখন পীরগাছা মিশনের খাবার টেবিলে বসেছিল এবং ইংরেজীতে ফাদার কার্ল, ফাদার ফারনান্দো ও ফাদার সিমোসের সঙ্গে কথা বলছিল, ফাদার হোমরিক তখন অদ্রিকে আচিক ভাষায় কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। অদ্রি উত্তর দিয়েছিল, তার মাহারি হলো চিসিম। ফাদার হোমরিক দুষ্টামি করে বলেছিলেন, চিসিম মাহারি ভালো না, আর নিজেকে বলেছিলেন তার মাহারি নকরেক। ফাদার হোমরিকের মাহারি নকরেক।

৮.
ফাদার হোমরিক আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। অনেক কথা হয়েছিল। এর মধ্যে দ্রম্নত খেয়ে টেবিল ছেড়ে আমার মেয়ে অদ্রি কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। হোস্টেলের মেয়েদের সঙ্গে। অনেক পরে মেয়ে এসে আমার কাছে একশ’ টাকা চেয়েছিল। বলেছিল, দিংজানদের (রঞ্জিত রম্নগার ছেলে) বাড়ি গিয়েছিলাম। ভ্যানভাড়া একশ’ টাকা দিয়ে অদ্রি বলেছিল, ভ্যানওয়ালা খুব খুশি হবে। ভ্যানওয়ালা মান্দি ছিল। আমি বলেছিলাম, কিভাবে চুনিয়া গেলে তুমি? পরে জানতে পারি, হোস্টেলের মেয়েরা ওকে হনুমান দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ও ছবি তুলেছে ক্যামেরায়। মেয়েরা ওকে দেখিয়েছে কোনটা কার বাড়ি। আমি বললাম, ভালোই হয়েছে। আমার আর সময় হয়নি। কোনদিন হয়তো হবে। বিশবছর পর বদলে যাওয়া নতুন চুনিয়াকে দেখতে যাব আমি। পীরগাছা থেকে ফেরার পথে দোখলা বাজারের কাছে ওই ব্রিজের কাছে আমি গাড়ি থামাই। ছবি তুলি। ধানের ক্ষেতে রোয়া লাগাচ্ছে কয়েকজন মান্দি নারী। মনে মনে কামনা করি, পীরগাছা--চুনিয়ার মানুষেরা ভালো থাকুক। আমি ফিরে আসি। যেতে হবে হালুয়াঘাট। ওখানে রাত যাপন শেষে পরদিন সকালে আমেরিকা দূতাবাসে মিটিং করার পর ফাদারগণ চলে যাবেন থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক। পরে আমেরিকা। জীবনের সময় কত দ্রম্নত চলে যাচ্ছে। এ অবলেট ফাদারগণ ব্যাংককে দু’সপ্তার জন্য এসেছিলেন মানবাধিকার বিষয়ক কর্মশালায় পৃথিবীর প্রায় ২০টি দেশ থেকে তিরিশ জনের অধিক। তাদের মধ্য থেকে এ চারজন বাংলাদেশে এসেছেন কাজ শেষে। আমাকেও তারা একদিনের জন্য ব্যাংকক নিয়ে গিয়েছিলেন লেকচার দিতে।

৯.
মধুপুর বনে মান্দিদের সমস্যা অন্যান্য মান্দি এলাকার চেয়ে একটু ভিন্ন। এখানের মান্দিরা এখন অনেক বেশি সংগ্রামমূখর। পরিস্থিতি ও সময় ওদেরকে এ পথে নামিয়েছে। কয়েকদিন আগে (২০০৭ সালে জুলাই মাসে) কারিতাস ময়মনসিংহ একটি ভূমি বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেখানে আমি বলেছিলাম, মধুপুর নিয়ে বিশেষভাবে এবং ভিন্নভাবে গুরম্নত্ব দিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ভূমির মালিকানা কী হবে, বনবিভাগ এবং সরকারের সাথে আদিবাসীদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এ বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট কাজ করা দরকার। সবাই বলেছেন, মধুপুর নিয়ে আলাদাভাবে ভাবা দরকার। কিন্তু আদিবাসী ও সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে অর্থপূর্ণ সংলাপ বা ডায়ালগ তো হলো না। অনিশ্চয়তা তো কাটলো না।

আমার ব্যক্তিগত অন্য একটি স্বপ্ন আছে মধুপুরকে নিয়ে। যদি কোনদিন আমার ভাবনা কাজ করে, বুদ্ধি যদি খোলে, তবে আমি একটি উপন্যাস লিখতে চাই। জানি না পারবো কিনা। সেখানে মধুপুর বনের বহুবছর আগের কথা থাকবে। এরকম উপন্যাস ইংরেজী, বাংলা বা অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে আছে। চিনুয়া আচেবে’র কথা নিশ্চয় অনেকে শুনেছেন, তার বই পড়েছেন। এখন যাদের বয়স সত্তুরের অধিক, যারা শৈশবে দেখেছেন মধুপুরে বন, জীবন কাটিয়েছেন বনের মধ্যে অন্যরকম, তাদের কথা শুনবো আমি। মধুপুর বনের গারো রাজা পরেশ মৃ বেঁচে থাকলে তার সাথে আমি কথা বলতাম। তাঁর শৈশব কেমন ছিল, তিনি তার বাবা-মার কথা মনে রেখেছেন কিনা, খ্রীষ্টান হওয়ার আগে তাদের জীবন কেমন ছিল, বিয়ের সময় তিনি কী করেছিলেন, পড়াশোনাই বা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল, তাকে জিজ্ঞেস করতাম। তার ছেলেমেয়েরা কি কিছু বলতে পারবেন? তাদের বাবার সম্পর্কে তারা কি লিখবেন? বিশেষ করে বাবুল দারম্ন। তিনি নাকি আগে লেখালেখি করতেন। আবার কি নতুন করে ভাববেন তার বাবার সস্পর্কে কিছু লিখার কথা? শুনেছি তিনি আজকাল ‘ওই জিনিসটা’ ভালোই খান। গরমকালে দুপুরবেলা খালি গায়ে জমিজমা দেখাশোনা করেন। তরম্নণ কালে তার লেখালেখির হাত ছিল। শুনেছি মেধাবী ছিলেন।

এরকম অনেক কিছু ইচ্ছা করে আমার। এখন আদিবাসী ফোরাম হওয়াতে আমার লেখালেখি কমে গেছে আগের চেয়ে। আগে প্রতি সপ্তায় তিন চারটি লেখা ছাপা হতো জাতীয় পত্রিকায়। এখন আর তা হয় না। একদিন আবার লেখালেখির জগতে ফিরে যেতে চাই। বাকী দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাই।

১০.
আমি সব সময় বলি, মধুপুরের বন ও ভূমি আদিবাসীদের ছিল। ওই অস্ট্রেলিয়ায়, নিউজিল্যান্ডে, আমেরিকায় বা কানাডায় যেভাবে ‘ইনডিজিনাস টেরিটরি’ ছিল, কাগজ বা দলিল থাকুক বা না থাকুক, সেই রকম। এই যে দলিল বা কাগজ নেই, এটিই আদিবাসীদের বিশ্বব্যাপী ভূমি মালিকানার সংস্কৃতি। এটি আদিবাসীদের স্বতসিদ্ধ ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার। আমত্মর্জাতিক কিছু সনদ এটিকে মেনেও নিয়েছে। সরকার যদি কাগজপত্রের কথাই শুধু বোঝে, তবে আলাপ-আলোচনা করে আদিবাসীদের ভূমির কাগজ দিয়ে দিক। এটিই তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত। মধুপুরের বন ও ভূমি যে আদিবাসীদের, তা নীচের কয়েকটি উদাহরণ খেয়াল করলে পরিষ্কার হবে। কেউ বলতে পারেন উদাহরণটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই।

অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির আদিবাসী প্রবীণ নেতা বিল নেজি বলেছেন, ‘ভূমিই আমাদের অসিত্মত্বের শেষ বিন্দু। ভূমি আছে বলে ওই আকাশ, মেঘ, নদী ও বৃক্ষরাজি, বাতাস, সমুদ্র বালুকণা সুন্দর। ভূমি আছে বলে জীবন এত গতিময়। ভূমি জীবনের প্রতীক। এ ভূমি আমাদের, আমরাও ভূমির। ভূমিতে আমরা বিশ্রাম নেই। আমরা ভূমি থেকে আসি, আবার ভূমিতে ফিরে যাই।’ মধুপুরের বনে মান্দিদের ভাবনাও এরকম ছিল একসময়। আমি একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছিলাম। সেখানে টেলকীর এক মান্দি ‘চু’ খাওয়ার আগে গস্নাস থেকে কিছু ‘চু’ মাটিতে ঢেলে বলেছিলেন, ‘এই মাটি, তুমিও পিপাসিত, কিছু পান করো।’ ইমোশনাল, অদ্ভূত সেই দৃশ্য।

১১.
শ্রাবণ বর্ষার দিনে আমি ফিরে এসেছিলাম পীরগাছা-দোখলা ছেড়ে। স্কুলের মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছিল। দূরে দাঁড়িয়ে ছিল চুনিয়া। এক সময়ের নামকরা মান্দি গ্রাম। গারোদের কত গ্রামই তো হারিয়ে গেছে, মান্দিশূণ্য হয়েছে। চুনিয়া নিশ্চয় হবে না সে রকম। কোনদিন। আর মন খারাপ করার কিছু নেই। মধুপুরের মান্দিরা বাঁচার মতোই বেঁচে থাকবে মানুষের মর্যাদা নিয়ে। অনেক মান্দি বন্ধুকে বলি, ফাদারদেরকেও বলি, ইদানিং মধুপুর থেকে অনেক ছেলেমেয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে। আমাদের সময়ে কম ছিল। এসবই তো আশার দিক, ভালো লাগা দিক। ঢাকার বিউটি পার্লারে অনেক মান্দি মেয়ে আবিমা’র। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ওরা কাজ করে। ভাইবোনদের পড়াশোনায় অর্থ দেয়, বাবা-মাকে সাহায্য করে। যতটুকু জানি, এখনো আবিমা’য় অনেক মান্দির বেশ জমিজমা আছে। এসব জমির অধিকার ও মালিকানা নিশ্চিত হওয়া দরকার। ‘ল্যান্ড ম্যাপিং’ ধরনের কাজ হওয়া দরকার। বর্তমান সরকারের আমলে নতুন করে বড় ঝামেলা হয়নি আবিমা অঞ্চলে। বন মামলার খবরও নতুন করে পাইনি। জেনে খুশি হয়েছি। জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদ ছাড়াও আচিক মিচিক সোসাইটি এখানে কাজ করছে। আচিক মিচিক সোসাইটির জন্মলগ্নের সঙ্গে আমারও কিছু যোগ আছে। একদল জাপানী নারী এসে আবিমার নারীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন, কিছু অর্থও তারা দিয়েছিলেন শুরম্ন করার জন্য। আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। জীবনে জীবন যোগ করা চেষ্টা করেছি।

আজ স্বপ্ন দেখি, একদিন আবিমা’র মান্দিদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত হবে। কেউ তাদের অপমান করতে পারবে না। এখানে এত মানুষ আর খুন হবে না। জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদ ৫০ বছর পূর্তি শেষ করে ১০০ বছর পূর্তি পালন করবে। তখন হয়তো আমি থাকবো না। তবু অমত্মরে এই সামত্মবনা রয়ে যাবে, একদিন আমিও ইকো-পার্কের সংগ্রামে, এই বনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, হাজার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। কবি শামসুর রাহমানসহ বহু বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিককে এ সংগ্রামে যুক্ত করেছিলাম। আবিমার আনন্দ-বেদনা-সংগ্রামের দিনে জীবনের গান গেয়েছিলাম। এই বনের ভেতরে বহুদূর পথ হেটেছিলাম। স্বজনহারা অশ্রম্নসজল মানুষের কষ্টের দিনে আমিও এসেছিলাম। তাদের নিয়ে পত্রিকায় কলাম লিখেছিলাম। তখন ভাবতাম, বুঝি বা এই অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। আজ সবার কথা মনে পড়ছে। চলেশের মেয়ে প্রিয়াংকার ক্রন্দরনত ছবি ভেসে উঠছে। আরো কত মুখ, ওই যে কথায় আছে, Sometimes, it's not the song that makes you emotional, it's the people and things that come to your mind when you hear it.



No comments: