Sunday, April 7, 2013

মাতৃসূত্রীয় গারো সমাজের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার প্রথা।

সোমা দে[*] ও পলাশ বসাক
মাতৃসূত্রীয় গারো সমাজের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার প্রথাঅতীতে পারিবারিক সম্পত্তি বলতে গারোরা বাদ্যযন্ত্র,  জমির ফসল, সংরক্ষিত শস্য, থালাবাসন, শুকর কিংবা সামান্য গয়নাগাটিকেই বুঝতোসময়ের পরিক্রমায় যাযাবর গারো সম্প্রদায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তখন থেকে স্থায়ী বসতভিটা এবং তৎসংলগ্ন সামান্য জমির মালিকানা নারীর ওপর বর্তাতে শুরু করে।
১৯৫১ সালে বনবিভাগ মধুপুর বন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আসিন হয়। আইন করে বন্ধ করা হয় গারোদের ঐতিহ্যবাহী জুম চাষ প্রথা। গারোরা বাধ্য হয়ে স্থায়িভাবে কৃষিকাজ শুরু করে এবং পরিবারগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত জমিরমালিকানার জন্যে প্রতিযোগিতা ক্রমান্বয়ে তীব্র হয়ে ওঠে।
বর্তমানে উৎপাদনশীল জমি গারোদের মূল্যবান সম্পদের মধ্যে অন্যতম ( কারও কারও মতে সবচে’ কাংক্ষিত)। ঐতিহ্য অনুসারে বসতভিটা এবংউৎপাদনশীল জমির মালিক পরিবারের প্রধান নারী (মা) এবং মায়ের অবর্তমানে পরিবারের কন্যাদের মধ্যে একজন সম্পত্তির মালিকানা লাভ করেএ প্রথায় ভূ-সম্পত্তির ওপর কেবল মা নয় মা’য়ের মাহারীভূক্ত আত্মীয় বর্গেরও সামষ্টিক দাবী থাকে।
গারো ভাষায় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কন্যা ‘নকনা’ নামে পরিচিক। ‘নকনা’ মনোনয়ন করা হয় এই প্রত্যাশায় যে, মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হবে তখন ‘নকনা’ও তার স্বামী তাদের এবং পারিবারিক সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে।  যদিও মা-বাবা তাদের কন্যা সন্তানদের মধ্যে কেবল একজনকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারিনী হিসেবে বেছে নেন, তবুও মধুপুর অঞ্চলে বসবাসকারী গারোদের মধ্যে ‘নকনা’ ব্যতিত অন্যান্য কন্যাদেরও (‘আগাতি’ হিসেবে পরিচিত) কিছুটা ভাগ দেয়া হয়। ‘আগাতি’রা তাদের বিয়ের পরে মা-বাবার বসত ভিটার কাছাকাছি তাদের আলাদা পরিবার গঠন করে কিন্তু ‘নকনা’ ও তার স্বামী তাদের সন্তানসন্ততিসহ মূল ভিটাতেই অবস্থান করে।
এটা একেবারে অজ্ঞাত নয় যে, বর্তমান গারো সমাজের নানা পরিবর্তনের সাথে সাথে ভূমি উত্তরাধিকার প্রথাতেও পরিবর্তন আসছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের ব্যপকতা কতোখানি তা খুঁজে বের করার খাতিরে আমরা ২০১১ সালে মধুপুর উপজেলার গাছাবাড়ি গ্রামের ১০০ টি এবং চুনিয়া গ্রামের ৯৪ টি বাড়ী বা খানা’র ওপর জরিপ চালাই। এছাড়া আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে এ দু’টি গ্রামের ৫০ জন গারো নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। সাক্ষাৎকারে উভয় গ্রামের অধিবাসীরাই বলেন যে বর্তমানে গারো পরিবারগুলোতে অশান্তির অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে জমি। বিগত বছরগুলিতে জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হয়নি, যদিও বেড়েছে জনসংখ্যা। শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে এবং পিতৃতান্ত্রিক বাঙালী সমাজের সাথে অধিক মেলামেশার কারণে গারো পরিবারগুলোতে ছেলেরাও এখন মেয়েদের সাথে জমির ভাগ চাইছেবাধ্য হয়ে পরিবারগুলিও বর্তমানে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও কিছুটা ভাগ দিচ্ছে। নিজের আয়ের মাধ্যমেও অনেক পুরুষ জমি কিনছেন। জমি ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে একদিকে, অন্যদিকে নারীরা হারাচ্ছেন ভূমির মালিকানা সত্ত্ব।
আমাদের প্রশ্নমালা জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে দেখা যাচ্ছে গাছাবাড়ি গ্রামের এক তৃতীয়াংশেরও বেশী (৩৫.২%) জমির মালিকানা বর্তমানে পুরুষদের হাতে। চুনিয়া গ্রামেও যথেষ্ট পরিমাণ জমির মালিকানা (১৯.৮%) রয়েছে পুরুষদের কাছে (টেবিল ১ ) বসত বাড়ির মালিকানার ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরণের চিত্র দেখা যায়এ দুটি গ্রামে (টেবিল ২)।
টেবিল ১:কৃষি জমিতে গারো নারী-পুরুষের মালিকানার ধরণ
মালিকানা
গাছাবাড়ি
চুনিয়া
মোট জমি (শতাংশ)
মোট জমি (শতকরা)
মোট জমি (শতাংশ)
মোট জমি (শতকরা)
স্ত্রী
৪,৬০৬
৫৫.৬%
৮,০৩২
৬৩.১%
স্বামী
২,৮২৯
৩৪.১%
২,১৫৫
১৬.৯%
অন্যান্য - নারী
৭৬৫
৯.২%
২,১৬৯
১৭.০%
অন্যান্য - পুরুষ
৯০
১.১%
৩৬৮
২.৯%





নারী
৫,৩৭১
৬৪.৮%
১০,২০১
৮০.২%
পুরুষ
২,৯১৯
৩৫.২%
২,৫২৩
১৯.৮%
উৎস:প্রশ্নমালা জরিপ ২০১১ (নমুনা সংখ্যাঃ গাছাবাড়ি – ১০০ টি বাড়ি/খানা; চুনিয়া –৯৪ টি বাড়ি/খানা)
টেবিল ২:বসত বাড়ি ও তৎসংলগ্ন জমিতে গারো নারী-পুরুষের মালিকানার ধরণ
মালিকানা
গাছাবাড়ি
চুনিয়া
স্বামী-স্ত্রীর যৌথ মালিকানা
৬%
৪%
স্ত্রী
৪৬%
৬১%
স্বামী
২৯%
২১%
অন্যান্য - নারী
১৪%
১৩%
অন্যান্য - পুরুষ
৫%
১%



নারী-পুরুষের যৌথ মালিকানা 
৬%
৪%
নারী
৬০%
৭৪%
পুরুষ
৩৪%
২২%
উৎস:প্রশ্নমালা জরিপ ২০১১ (নমুনা সংখ্যাঃ গাছাবাড়ি – ১০০ টি বাড়ি/খানা; চুনিয়া –৯৪ টি বাড়ি/খানা)
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ নারীর ক্ষমতায়নে ভুমির অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ ভুমির মালিকানার সূত্র ধরেই নারী উৎপাদনশীল খাতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে যার মাধ্যমে পরিবার ও সমাজে তার অবস্থান দৃঢ় হয়। যদিও গারো সমাজের নারীদের ক্ষেত্রে এ ধারণাটি পুরোপুরি প্রজোয্য নয়, কারণ ভূমির মালিকানা থাকা সত্ত্বেও গারো সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে বিধায় পারিবারিক কিম্বা অর্থনৈতিক যেকোন ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের মুখাপেক্ষি হতে হয়। তবুও ভুমি অধিকার বঞ্চিত সমাজের নারীদের তুলনায় গারো নারীরা ভূমি  ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করতে পারে, যেহেতু তাদের সাথে পরামর্শ না করে বা তাদের না জানিয়ে পুরুষ ভূমি ব্যবহার, বর্গা দেয়া বা কেনা বেচা সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না
আমাদের গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষদের মতে মাতৃস্থানীয়  (matrilocal) পরিবার প্রথা টিকিয়ে রাখার জন্যেও ভূমিতে নারী অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। পুরুষেরা ভূমির অধিকার পেলে স্বাভাবিকভাবে গারো সমাজে  প্রচলিত জামাই যাবার প্রথা কমে যাবে, যা ইতিমধ্যেই মধুপুর এলাকায় দেখা যাচ্ছে।  আমাদের প্রশ্নমালা জরিপে আংশগ্রহণকারী পুরুষদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী জামাই যাননি (টেবিল ৩)। অন্যদিকে এক চতুর্থাংশেরও বেশী নারী বউএসেছেন (টেবিল ৪)। জামাই না যাবার অথবা বউ আসার এই প্রবণতা গারো সমাজের ভূমির মালিকানার বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে এবং ক্রমশ দূর্বল হয়ে পরতে পারে মাতৃসূত্রীয় (matrilineal)সমাজব্যবস্থা।
টেবিল ৩: গারো পুরুষদের জামাই যাবার বর্তমান প্রবণতা
জামাই গিয়েছেন
গাছাবাড়ি
চুনিয়া
হ্যাঁ
৪৯%
৪১%
না
৫১%
৫৯%
উৎস:প্রশ্নমালা জরিপ ২০১১ (নমুনা সংখ্যাঃ গাছাবাড়ি – ৩৯ জন পুরুষ; চুনিয়া – ৩৭ জন পুরুষ)
টেবিল ৪:গারো নারীদের বউ যাবার বর্তমান প্রবণতা
বউ গিয়েছেন
গাছাবাড়ি
চুনিয়া
হ্যাঁ
৩৯%
২৬%
না
৬১%
৭৪%
উৎস:প্রশ্নমালা জরিপ ২০১১ (নমুনা সংখ্যাঃ গাছাবাড়ি – ৬১ জন নারী; চুনিয়া – ৫৭ জন নারী)
স্থানীয় গারো নারীদের মতে,বাঙালীদের সাথে মেলামেশা এবং আধুনিক শিক্ষার প্রাভাবে গারো যুবকরা জামাই যেতে লজ্জ্বা পান। অপরদিকে ছেলেদের দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে অনেক মেয়ে বউ যেতে বাধ্য হন। তারা আরও বলেন, মাতৃস্থানীয় পরিবার প্রথার অবলুপ্তি হলে বিবাহিত বাঙালী ও গারো নারীদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। গারো সমাজে বেড়ে যেতে পারে নারী নির্যাতনের হার এবং গারো মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রেও যৌতুকের মতো ভয়াবহ ব্যধির সহজ অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, বর্তমান বিশ্বে কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং নারী-পুরুষের সমতা বিধানের লক্ষ্যে নারীর ভূমি অধিকার নিশ্চিকরণের দাবী যেখানে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে সেখানে দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে গারো নারীরা তাদের প্রচলিত ভূমি অধিকার হারাতে বসেছে। আমরা আশা করি গারো পুরুষরা কেবল অন্ধভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মডেল অনুসরণ না করে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার থাকার সুফলগুলি অনুধাবন করবেন। পাশাপাশি গারো নারীরাও তাদের ভূমি অধিকার রক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট হবেন।























No comments: