আমার বাবার কথা
মৃতঃ
পরেশ চন্দ্র মৃ এর সংক্ষিপ্ত জীবন কথা
মুকুল
দারু ( মেয়ে)
আজ থেকে প্রায় আশি পচাঁশি বছর পূর্বে মধুপুরের বন
ছিল যখন ভরা যৌবনা, বনবাসীদের সবুজে-শ্যমলে লগলগে সিন্ধ রূপের চোখ ঝলসানো রূপের
বহারে প্রকৃতি মুগ্ধ আবেশে থমকে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো ঠিক সেই সময়ে আমার
বাবা মানে জয়েনশাহী আদিবাসীর প্রতিষ্ঠাতা মৃতঃ পরেশ চন্দ্র মৃ এর জন্ম। সাল ছিল
তখন ১৯২৯। মধুপুর বাসীগন আদিবাসী জাতীর বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্মের চেতনাতে চির
ভাস্বর করে রাখার জন্যে এই কিংবদন্তি মহা পুরুষকে গারো রাজা
সন্মানে ভহষিত করেছিলেন। আমরা তার ছেলে মেয়ে এ স্বীকৃতি প্রদানে গর্বিত এবং বিশেষভাবে যিনিরা এর উদ্যোক্তা ছিলেন তাদেরকে এবং মধুপুর আদিবাসী সকলকে ধন্যবাদ জানাই ।
সন্মানে ভহষিত করেছিলেন। আমরা তার ছেলে মেয়ে এ স্বীকৃতি প্রদানে গর্বিত এবং বিশেষভাবে যিনিরা এর উদ্যোক্তা ছিলেন তাদেরকে এবং মধুপুর আদিবাসী সকলকে ধন্যবাদ জানাই ।
আমার বাবারগ্রামের নাম চুনিয়া। তার মায়ের নাম-দেংয়া মৃ বাবার নাম-রায়চান
নকরেক। বাবার দুই মা ছিলেন দ্বিতীয় মায়ের নাম চেংয়া মৃ। বাবরা দুই ভাই ছিলেন ১)
গজেন্দ্র মৃ ( বড়ভাই) ২) পরেশচনদ্র মৃ (আমার বাবা)। আচ্ছুর (দাদুর)ঐকান্তিক
ইচ্ছার জোরে নিজ গ্রামে স্কুল না থাকলেও গভীর বনের ভিতর দিয়ে প্রায় মাইলেরও বেশী
দূরে ভূটিয়া গ্রামে গিয়ে ব্যপ্টিস্ট মিশনারী প্রাইমারী স্কুলে দুভাইকে ভর্তি করা ১৯৩৫
সালে্ সেখানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পান।
পরবর্তীতে সাইনামারীতে ছাত্র
কম হওয়াতে মিশন স্কুল ভেঙে পীরগাছাতে ক্যাথলিক ফাদারগন স্কুল প্রতিষ্ঠা করে । তখন
ফাদার বিদেশী ছিলেন নাম কেইন। কাটিখিষ্ট শিক্ষক ছিলেন দেবেদ্র দফো (
বর্তমানে নয়া পাড়াতে মিঃ প্রবীণ চিসিমের আচ্ছু)। পরবর্তীতে বোর্ড স্কুল / সরকারী
স্কুল করা হয়। সে স্কুলে বাবা চলে আসেন। সরকারী স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা
বাধ্যতামূলক ছিল। মধুপুরের পশ্চিমে গোপালপুরে ( প্রায় ১৭মাইল দূরত্ব) পরীক্ষার
সেন্টার ছিল। তখনকার সময়ে পায়ে হাটা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা। কাঁচা রাস্তায় গরুরগাড়ী
ছাড়াআন্য কোন যানবাহন চলতনা। দাদু গরুর গাড়ীতে করে বহুকষ্টে বাবাকে পরীক্ষা দিতে
নিয়ে গিয়েছিলেন। সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল।
ছেলেদের শিক্ষিত করার বিষয়ে দাদু ছিলেন সমস্ত
যুক্তিতর্কের উর্ধে। তিনি নিজে লেখাপড়া করারর সুযোগ পাননি তাই তার ইচ্ছা ছিল যেমন করে হোক যেভাবেই হোক শিক্ষিত করতে হবে। বাবরও ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি ভীষন
জোক ছিল।তাই দাদু পরবর্তীতে মধুপুর হাইস্কুলে পড়াশোনা করারর জন্যে ভর্তি করে দেন।
তখনকার সময়ে হোস্টেলের কথা চিন্তাই করা যেতনা্। তিনি বঙ্কিম চক্রবর্তী নামক এক
হিন্দু বাড়ীতে লজিং থেকে পড়াশোনা করারর সুযোগ পান। বিনিময়ে সে বাড়ীতে টাকা, চাউল
এবং রান্নার জন্যে লাকড়ি দিয়ে যেতেন।
১৯৪৫-১৯৪৬ সাল হবে যখন দেশে হিন্দু মুসলিম দাঙগা
বেধেছিল তখন অনান্য হিন্দু পরিবারের মতো বঙ্কিমবাবুর পরিবারও নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে কলকাতায়
চলে যান। বঙ্কিমবাবু বাবাকে এতই স্নেহ করতেন যে তিনি তার পরিবারের সাথে বাবাকেও
সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে যান। সেখানে নারিকেল ডাঙ্গা হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন।
সেকানেও দাদু মাসে মাসে লোক মারফৎ টাকা পাঠাতেন। এই বঙ্কিম বাবুর কাছ থেকেই তিনি
সমাজ রক্ষার মন্ত্র পান। বঙ্কিমবাবু ছিলেন বুদ্ধিমান এবং রাজনীতিবিদ। তিনিস্কুলে
পড়াকালীন সময়ে বাবাকে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ যেমন রামায়ন, মহাভারত, গীতা ও বেদান্তর
দর্শণ পড়তে দিতেন এবং নিজে ব্যাখা করে বোঝাতেন। আবার এর পাশাপাশি সাম্যবাদ ও নাস্তিকবাদের
বিভিন্ন বই পরতে দিতেন এবং সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করতেন। এভাবে এ বয়সেই
তিনি মাওসেতু, মেসিম গোর্কি, এঞ্জেলস ও লেলিনের বই পড়ে ধীরে ধীরে তাদের নীতি ও
আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠে। তাছাড়া বঙ্কিম বাবুর বাসাতে থাকাকালীন সময়ে কংগ্রেস ও
মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতক্ষ্য করেছেন এবং সে বাড়ীতে অনেক বড় বড় রাজততিক
ব্যক্তিদের আনাগোনা ও সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা শুনতেন। তখন থেকেই তিনি নিজেদের
সমাজের দুরাবস্থার কথা চিন্তা করতেন এবং পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। মূলত সমাজ
পরিবর্তনের চেতনা ও পিছিয়ে পরা সমাজের জন্য কাজ করার অদম্য ইচ্ছা ও মানসিক শক্তি
সেখানেই জাগরিত হয়। (এ কথা অনস্বীকার্য যে পরবর্তী জীবনের প্রতিটি মহৎ কাজের
পিছনে বঙ্কিম চক্রবর্তীর অবদান অনেক রয়েছে। আমরা মধুপুরের আদিবাসী তাঁর
কাছে কৃতজ্ঞ।) দশম শ্রেণীপর্যন্ত সেখানে লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানের
আবাহাওয়া তার সাস্থ্যের জন্যে অনুকুল না হওয়াতে সবসময় অসুস্থ থাকতেন তাই আচ্ছু
(দাদুর) বাধ্য হয়ে দেশের বাড়ীতে নিয়ে
আসেন। অসুস্থতার কারনে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি।
বড়ীতে আসার পর চিকিৎসায় সুষ্ঠ হয়ে উঠলে আবারও
উচ্চতর শিক্ষার হাতছানি তে বাবা ব্যকুল হয়ে উঠেন (সাথে দাদুও)। পরবর্তীতে ইদিলপুর
গ্রামের মিজি মৃ এর সহযোগিতায় কলকাতায় চার্চ অব বাংলাদেশ মিশন স্কুলে থাকা ও
মেট্রিক পরীকবষা দেয়ার সুযোগ আসে। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেলায় তিনি আবারও হেরে
যান। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উচ্ছতর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে কলকাতায় যাওয়ার মুহূর্তে র্দীঘ দিনের তিলে
তিলে খুড়ে খাওয়া যক্ষা রোগ আত্নপ্রকাশ করে। আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময়ে আদিবাসী সমাজে
কবিরাজ ও বিভিন্ন দেবদেবীর পূজাছাড়া কোন উপায় ছিলনা। তখনকার সময়ে প্রচলিত প্রবাদ বাক্যই ছিল ‘‘ যার হয় যক্ষা, তার নাই রক্ষা’’।
বাবা ও দাদুর সপ্ন অথাৎ প্রতিষ্ঠানিক লেখা পড়ার পালা এখানেই ইতি ঘটে। কিন্তু
শিক্ষার কোন শেষ নেই, তিনি বাইরে থেকে অজস্র বই কেনা ও বই পড়া ছাড়েননি। তিনি মেক্সিম
র্গোকি,হিটলার লেলিন ও মাওসেতুর জীবনী থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম চন্দ্র,
শরৎচন্দ্র, ফালগুনী আরো অনেক বিখ্যাত লেখকের
বইকিনে পড়াশোনা করে জ্ঞানার্জন করেন (এক সময় তার আলমারীতে অনেক বই সংগ্রহে ছিল)।
ছোট বেলাতে আমি বাবার দেখাদেখি বাবাকে খুশী করারর জন্যে না বুঝেই অনেক দুর্বোধ্য বইগুলো
পড়েছি। আমার বাবা নিজেও যেমন পড়তেন অন্যকেও পড়তে উৎসাহিত করতেন এবং বই পড়ার জন্যে
অনেককেই বই দিয়ে দিতেন যার কারনে অনেক বই আর ফেরৎ আসেনি এবং যত্নের অভাবে অনেক বই নষ্ট
হয়ে গেছে।
বাবা ছিলেন জন্ম সূত্রে সাংসারেক (গারোদের
বিশ্বাস বা ধর্মের নাম)। একটি হিন্দু
/সনাতন ধর্মাবলম্ব^ীর পরিবারে বড় হওয়ার কারনে সনাতন ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও
দুর্বলতা বেশী ছিল। কিন্তু ইশ্বরের পরিকল্পনা ছিল অন্য রকমের। তাই সকল আদিবাসীদের
বিশ্বাস ও কথা উপেক্ষা করে তিনি গারো
দেবদেবীর পূজার সাথে সাথে বড় বড় ডাক্তার ও হাসপাতাল খুuঁজতে লাগলেন। লেখাপড়া না
জানলেও দাদু ছিলেনঅনেক বুদ্ধিমান ও বিচক্ষন ব্যক্তি। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা
করেছিরেন যে করেই হোক ছেলেকে বাচাঁতে হবে। আ্মার চেতনায় আমার আচ্ছু ছিলেন সে যুগের
বিচক্ষন ও বুদ্ধিমান সেহময়ী পিতা।
তিনি খুজঁতে খুজঁতে ময়মনসিংহ সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে
কর্মরত যক্ষা বিশেষ্যজ্ঞ ডাক্তারের খোঁজ পেয়ে যান। সেই খ্যাতনামা ডাক্তারের নাম
ছিল ডাক্তার বেনেডিক্ট ইয়া ( বিদেশী)। হাসপাতালে বাবার রুমেই আর একজন টিবি রোগী
ছিলেন নাম চালর্স পিউরিপিকেশন (বাঙ্গালী খৃষ্টান,ক্যাথলিক )। পাশাপাশি একই রুমে
থাকার ফলে দুুজনের মাঝে আন্তরিকতা গড়ে
উঠে এবং বাবা খৃষ্ঠান নন জানার পর সুযোগ পেলেই খৃষ্ট ধর্ম নিয়ে বাবার সাথে আলোচনা
করে এবং বাইবেল থেকে শুরু করে ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় বই পড়তে দেন। এভাবে খ্র্যীষ্ট ধর্মের সাথে তার পরিচিতি ঘটে এবং ধীরে ধীরে
খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি বিশ্বাস গভীরতর হয় । পাশের রুমে এক বাঙ্গালী খৃষ্টান মহিলা
টিবি রোগী ছিলেন নাম ভির্জিনা গমেজ। তিনিও বাবাকে খ্রীষ্টধর্মের বিভিন্ন বই সংগ্রহ
করে দিতেন এবং মন পরিবর্তনের জন্যে র্প্রাথনা করতেন। বাবা এক সময় সুস্থ হয়ে বাড়ী
ফিরে আসেন। ১৯৫২ সালে তিনি খ্রীষ্ট ধর্মে দিক্ষিত হন।
আমার বাবা নিজে অসুস্থ থেকেও সমাজের মানুষদের
উন্নয়নের চিন্তা করতেন এবং সাধ্যমতো উপকার করতেন। মধুপুরের যে গ্রামগুলোতে
আদিবাসীদের বসবাস ছিল সেখানকার চারদিক গভীর বনে ঢাকা ছিল। জুমচাষ ছাড়া অন্য ফসল
করা জানতোনা। জীবনের চাওয়া পাওয়াও ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু বাবার চিন্তা চেতনা ছিল অনেক
গভীরে এবং সূদুরপ্রসারী। তিনি প্রায়ই ইদিলপুর তার আত্নীয় মিচি মৃ এর বাড়ীতে যেতেন।
চার্চ অব বাংলাদেশ মিশনারীর সহায়তায় এদিকের তুলনায় তারা ছিল শিক্ষা দীক্ষা ও
চিন্তাচেতনায় আরো অগ্রগামী। মিচি মৃ এলাকাতে চার্চ অব বাংলাদেশ মিশনারীর নেতৃত্ব
দিতেন। তিনি বাবাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরামর্শ দিতেন। এলাকার
গারো সমাজের ভবিষৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁর পরামর্শে বাবা প্রথম তার কাছ
থেকে ফলের চারা ( আনারস, লেবু, লিচু, আম কাঠলি ইত্যাদি) নিয়ে আসেন এবং গ্রামে ফলের
বাগান শুরু করেন্। পরবর্তীতে তিনি এলাকার সকলকে চারা লাগাতে উৎসাহ ও পরামর্শ দেন
এবং চারা বিলাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে চুনিয়া পীরগাছা, সাইনামারী থানারবাইদ সহ আরো
অনেক গ্রামে ফলের বাগান ছড়িয়ে পরে এবং ঝুম চাষের পাশাপাশি ফল বিক্রি করে সংসারে
বাড়তি আয় হতে থাকে। সাথে সাথে এলাকা বাসীদের উৎসাহ বাড়তে থাকে।
সমাজের জন্যে বাবার আর একটি বড় অবদান হলো-সে সময়ে
এলাকাতে কোন ডাক্তার না থাকাতে অনেক লোক ম্যালিরিয় ও কালা জরে মারা যেত। ছোট
বাচ্ছা মারা পড়তো বেশীরভাগ ডাইরিয়া ও নিমুনিয়া অসুখে। এলাকার কবিরাজ ও দেবতার ভোগ
ও পূজা ছাড়া আর গারো ও অনান্য আদিবাসীদের কোন ঔষধ জানা ছিলনা। পাশ করা ডাক্তারতো চিন্তা
ওস্বপ্নের বাইরে ছিল। এলাকার এই করুণ অবস্থা দেখে বাবা নিজে হোমিওপ্যাথি ও এলোপ্যাথি
চিকিৎসার বই কিনে এনে পড়াশোনা শুরু করেন এবং এলাকা বাসীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা
দিতে থাকেন। দুরদুরান্ত থেকে অনেক রোগী আসতো এবং তখন বাবার চিকিৎষায় অকে আদিবাসী ও তাদের শিশু জীবন ফিরে পায় ( পা্রক্তন
জয়েনশাহীর সভাপতি অজয় এ মৃ এর জীবনেও বাবার এ অবদান রয়েছে)। তখন এলাকাতে বাবার
ডাক্তারী কাজের এমন সুনাম ছড়িয়ে পরেছিলযে এক সময় পরেশ ডাক্তার নামে মধুপুর এলাকাতে
বাবার ব্যপক পরিচিতি ও লাভ করেছিল। হয়তো
বাবার মানসিক প্রবল ইচ্ছা ও আর্শীবাদে বর্তমানে তাঁর পরিবারে ম্যডিকেল পাশ করা ২জন
ডাক্তার রয়েছেও দুজন নাতি মেডিকেলে পড়াশোনা শেষের পথে আছে আমরা আরো আশা করছি আগামীতে
বাবার সপ্ন পূরণে এ পরিবারো আরো ডাক্তার আসবে ।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও এলাকাটি পিছিয়ে ছিল।তখনকার
সময়ে এলাকাতে কোন শিক্ষিত লোক ছিলনা বিধায় মিশনারী ফাদারগন ঢাকা থেকে বাঙ্গালী
খৃষ্টানদেরকে এনে স্কুল চালাতেন। সেই সময় পীরগাছা স্কুলের বাঙ্গালী শিক্ষক বড়দিন
ছুটিতে চলে গিয়ে না আর না আসাতে স্কুল প্রায় বন্ধে হয়ে যাবার পথে ফাদার হোমারিক
বাবাকে দায়িত্ব দেন এবং বাবা সে দায়িত্ব গ্রগণ করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি দায়িত্ব
পালন করেন এবং আবার অসুস্থ হলে আব্যাহতি নেন। কিন্তুও এলাকার আদিবাসীদের শিক্ষার
আলো প্রজ্জলিত রাখার প্রচেষ্টায় স্কুলের ও র্গীজার উন্নয়নের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম
করে যান এবং এরই ফলসরূপ বর্তমান পীরগাছা গ্রামের বুকে স্বগৌরবে মাথাউচু করে দাঁড়িয়ে
থাকা সেন্ট পৌল হাই স্কুল ও আজকের পীরগাছা মিশন। যেখানে আমাদের অনেক
ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে পারছে এবং সুন্দর ও সুষ্ঠু জাতি গঠনের জন্যে উপযুক্ত
প্রজন্ম তৈরী হচ্ছে সাথে পাচ্ছে আধ্যাত্নিক গঠনের সুযোগ।
। সমাজ উন্নয়নের কাজের
পাশাপাশি আদিবাসী সমাজের অন্যায় অত্যাচারের বিরূদ্ধে রম্নÿÿ দাড়াবার মতো মনোবল
এবং প্রবল ইচ্ছা শক্তি ইশ্বর তাঁকে দিয়েছিলেন। কিশোর বয়সেই বাবার সংগ্রামী জীবনের প্রকাশ। পাকিস্তান শাসনামল, ১৯৫২ সালে জমিদারী প্রথা
উচ্ছেদের সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার আদিবাসীদের একমাত্র আয়ের উৎস ঝুমচাষ বন্ধ করে
দেন। তখনই থেকেই তিনি সরকারের বিরূদ্ধে প্রকাশে প্রতিবাদ করেছেন। মধূপুর আদিবাসীদের
ভূমির ন্যায্য অধিকারের লড়াই এখান থেকেই শুরু। আবার ১৯৫৬ সনে মধুূপুরের আদিবাসী অধ্যুসিত
গ্রামের বনানঞ্চলগুলো ধনী ব্যবসায়ীদের নিলামে বিক্রি করে দেয়। সেখানে তারা বড় বড়
গাছ কেটে বিক্রি করে বন নষ্ট করে। সরকার সেখানে আবার নূতন করে গজারী ও শাল বাগান
করে এবং আদিবাসীদের বাগান ও আবাদি জমিতেও চারা লাগানো শুরু করে। সে সময় থেকেই
সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করতে শুরু করেনে আজো আমরা করে যাচ্ছি এর শেষ
কোথায় জানিনা ? বন বিভাগের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের সাথে দাবী দাওয়া
নিয়ে বার বার আলোচনা ও এলাকাবাসীদের অনুরোধে সেবারে মতো আদিবাসীদের আবাদি জমি সাময়িক
ভাবে রেহায় পায়।
১৯৫৬ সনে আবারও আদবাসীদের উপর আঘাত আসে।
১৯১২সন থেকে ১৯১৯ সন পর্যন্ত সিএসসি
রেকর্ড করা আদবাসীদের পত্তনী জমিগুলো নটিফিকেশন করে খাস ঘোষনা করে ও বনবিভাগের
আওতায় নিয়ে যায়। তখন বাবা আরো কয়েকজন আদিবাসী নেতাদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন
পর্যায়ে আলোচনায় বসেন। এলাকার আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তার নেতৃতে সরকারের
কাছে সকলে মিলে মৌখিক ও লিখিত ভাবে আপত্তি জানান। এভাবে সকল আদবাসী জমি তখনও
সাময়িক রক্ষা পায়।
১৯৬১ সনে পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা
( এ মুহূর্তে নাম জানা যায়নি) দোখালা আসেন এবং এলাকাবাসীদের সাথে সভায় বসেন। তখন
তিনি মৌখিক ভাবে ঘোষনা দেন যে এলাকার ৪০বর্গ মাইল নিয়ে অর্থাৎ আদিবাসী গ্রামগুলো যেমন চুনিয়, পীরগাছা, সাইনামারী, থানারবাইদ,
বেদুরিয়া,খাইলাকুড়ি জালাবাদা ও আশপাশের আরো ১২-১৫টি গ্রাম নিয়ে ন্যশনাল পার্ক করা
হবে এবং সমস্ত আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদ করা হবে। আবারও পরেশ বাবুর
নেতৃতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মধুপুরের আদিবাসীগন সরকারের কাছে প্রতিবাদ লিপি প্রদান
করেন।
১৯৬২ সনে প্রথমে শুধু চুনিয়া গ্রামের আদিবাসী
পরিবার উচ্ছেদের পায়তার করে। কারণ তাদের ধারনা ছিল পরেশ বাবুর নেতৃতে আদিবাসীদের
প্রতিবাদ জোড়ালো হচ্ছে। নেতার গ্রামটি নড়াতে পারলে অন্যগুলো এমনিতেই ভয়ে উঠে যাবে।
তারা বাবাকে নানা ধরনের লোভনীয় প্রলোভন দেখাতে লাগল যেমন -টাঙ্গাইল জেলাতে তার
নামে বড় বাড়ী সহ জমি (তার চাহিদা অনুসারে) দেয়া হবে, ভারতে যেতে চাইলে পাশপোর্ট
ভিসা দিয়ে দিবে এবং সাথে ক্ষতিপূরণ সরূপ যথেষ্ট পরিমা টাকা দেয়া হবে যাতে সেখানে
আরো ভালো থাকতে পারে, অথবা পার্কের আওতার বাইরে যেখানে যেতে চয় তার জন্যে রাজকীয়
ব্যবস্থা করে দেয়া হবে- ইত্যাদি ইত্যাদি----। বাবা সব প্রলোভনকে ঠেলে দিয়ে জাতির
অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখার মহান দায়িত্ব পালন করেন। আজকে এ কথা ভেবে উঠি সেইদিন যদি
বাব প্রলোভনকে জয়করতে না পারতেন তাদের
প্রলোভনে পা রাখতেন আজকে কোথায় দাড়াঁতো মধুপুরের বুকফুলিয়ে চলা এই আদিবাসীদের
মুখের হাসি। বাবার উক্তি ছিল ‘‘এ গ্রাম
ও এ বন ছেড়ে আমরা কোথাও যাবনা। আমরা বনের সন্তান বন ছাড়া আমরা বাচঁতে পারবনা।’’ (
বাবা তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ)
১৯৬২সন এক ঐতিহাসিক বছর। সেই বছরে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ
করা ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ফাদার উয়াং এর পরামর্শ ও সহযোগিতায় একটি
সংগঠন শুরু করেন। নাম ছিল ‘‘জলছত্র জয়েনশাহী আদিবাসী ঋণদান সমবায় সমিতি’’ বর্তমানে
যা ‘‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯৬৭ সনে আবারও বাবার পুরোনো রোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তাকে বারমারী মিশন
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সি্স্টার ইম্মানুয়েল ছিলেন নামকরা বিদেশী ডাক্তার। তার চিকিৎসায়
কিছুটা সুস্থ হলে গ্রামে তার মায়ের মৃত্যু ঘটে এবং মাকে দেখার জন্যে তিনি বাড়ততে
চলে আসে। পরবর্তীতে আবার ময়মনসিংহ সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। সেখানে
সুস্থ হলে আবার গ্রামে ফিরে আসেন।
১৯৬৭ সনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনায়েম খাঁন দোখালাতে আসেন এবং আদিবাসীদের উচ্ছেদ এবং
পনর্বাসনের কথা ঘোষনা করেন। কিন্তু বাবা অসুস্থ অবস্থাতেই সকল আদিবাসীদের এক জোট
হয়ে নিজ গ্রামে বসবাস করারর জন্যে সকলকে অনুরোধ করেন এবং সাহস দেন।
১৯৬৮ সনে চুনিয়া গ্রাম ক্ষতি পূরণ প্রদান করে উচ্ছেদের নোটিশ দেয়া হয়। বাবা
তখন আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেন। তার নেতৃতেই সকলে মিলে সরকারের কাছে লিখিত প্রতিবাদ জানান
এবং লিখিত দেন যে, যে এলাকাতে যেখানে বন
আছে সেখানে পার্ক তৈরী করুক তাতে তাদের আপত্তি নেই কিন্তু তারা কেউ গ্রাম ছেড়ে
যাবেনা। অনেক দেনদরারের পর বিষয়টি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়।এরপর আসে ১৯৭১ দেশ স্বাধীনের যুদ্ধ। অনেক আদিবাসীও বুকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে জীবন
বাজি রেখে যুদ্ধ করে। এক সময় দেশ স্বাধীন হয় কিন্তু মধুপুর আদিবাসীদের ভাঙ্গা কপাল
জোড়া লাগলোনা। ১৯৭২ সনে শেখ মুজিব নিজে ও
। আনান্য মন্ত্রী বর্গ দোখালা আসেন
সংবিধান রচনা করতে। তখনও শেখ মজিব নিজেই ঘোষনা দিলেন আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদের। তখনও
বাবার নেতৃতে আইন মমী¿ , বনমন্ত্রী সহ
বিভিন্ন বড় বড় নেতাদের কাছে উচ্ছেদ প্রথা বন্ধের আবেদন করেন। অনেকে আশ্বাস দিয়েছে
কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। অবশেষে ১৯৭৪সনে মজিব শাসনের পতন হলে আবার বিষয়টি স্থগিত হয়।
১৯৮০সনে জিয়ার সামরিক শাসন আমলে
সামরিক আইন অনুযায়ী আবার উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়। বাবা এলাকার লোকজনদের নিয়ে
সরকারের বিভিন্ন দফতরে আবারও প্রতিবাদ লিপি প্রেরণ করে এবং বিভিন্ন মহলে আলাপ
আলোচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সনেই আদিবাসীদের আর উচ্ছেদ করা হবেনা বলে ঘোষনা দেন। কিন্তু বর্তমানেও
আদিবাসীরা যাতে গ্রাম ত্যাগ করে চলে যেতে
বাধ্য হয় তার জন্যে বিভিন্নভাবে সরকার অত্যাচার করে চলেছে্ । তবে সবকিছু ঘাত
প্রতিঘাতের মধ্যেও মধুপুরের আদিবাসী আমরা তোমার আদর্শকে পাথেয় করে সংগ্রামের মাধ্যমে টিকে আছি।
সামাজিক কাজে যেমন বাবার অবদান রয়েছে তেমনি ধর্মীয় কাজেও তার অবদান রয়েছে।
মিশনের প্রত্যকটি কাজে এবং বড় কোন অনুষ্ঠান হলে গ্রামের লোকদের নিয়ে চাল ডাল ওয়াক
সহ প্রয়োজন মতো সাহায্য করতেন। নিজ খরচে
বাড়ীতে স্কুলের শিক্ষকদের ও ছাত্রদের লজিং রাখতেন। সেমিনারিয়ানদেরকে ও বিনা খরছে
বাড়ীতে রাখতেন। যেমন ফাঃ বেঞ্জামিন কস্তা ও ফাঃ বানার্ড পালমা ব্রত গ্রহণ করার আগে
১ মাস করে গ্রামে কাজ করার জন্যে এসেছিলেন। গ্রামে ফাদার ও বিশপগন এলে তাদের থাকা
খাওয়া বিষয়ে যত্ন নিতেন। তিনি যেমন মিশনের জন্য কাজ করতেন তেমনি মিশনের ফাদারগনও
তার সংগ্রামী কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করতেন এবং পরামর্শ দিতেন। বিশেষ ভাবে ফাদার
হোমারিকের নাম না বললেই নয়।
বাবার সংসার জীবন শুরু হয় ১৯৫৬ সনে। আমার বাবা বিয়ে করেছিলেন ভালুকা নিবাসী
বর্তর্র্মান নলুয়াকুড়ি মিশনাধীন কমলা দারুর মেয়ে শিশিলিয়া দারুকে। আমার আচ্ছু অনেক
খোঁজ করে বাবার জন্যে শিক্ষিত বউ ঘরে এনেছিলেন। আমার বাবার সমাজ রক্ষার মহান
দায়িত্ব পালনে আমার মায়েরও অনেক অবদান রয়েছে। এখানেও তিনি গারোদের প্রচলিত রীতির
বাইরে কাজ করে অনেক সাহসের পরিচয় দেন। মাত্রিতান্ত্রিক গারো পরিবারে ঘরে বউ এনে
আজীবন মা-বাবার ঘরে সংসার করে যওয়া তখনকার দিনে ( এখনও সম্ভব হয়ে উঠেনা) চিন্তা
করা যেতনা। বাব সেটা সম্ভব করে আদর্শ দেখিয়ে গেছেন। তিনি ভালুকাতে ঘর জামাই না
গিয়ে এলাকাতে বউ এনে আজীবন আদিবাসীদের অস্থিত রক্ষার আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
এখানে আচ্ছুর বিচক্ষনতার প্রসংসা নাকরে পারছিনা। ভালুকাতে ঘর জামাই চলে গেলে আজকের
মধুপুর এলাকার ঝলমলে আদিবাসী গ্রামগুলোর
কি দশাটাইনা হতো সে দৃশ্য ভাবা যায় ? আর অস্থিত্ব ? উত্তর পাঠকদের জন্যে
রেখে দিলাম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অনেক মেডেল ও পুরস্কার
পেয়েছেন। সামাজিক কাজর জন্যেও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। শেষ বয়সে তিনি বার্ধর্ক্য
জনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন এবং হঠাৎ ১৯১৮ সনে ৭ই মার্চ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক
মাসে রাত ১২.০০দিকে স্ট্রে্রাক করে মারা যান। ( তার আত্নার শান্তির জন্যে সকলে
র্প্রাথনা করবেন।)
আমারা তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে -তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বাবার
আদর্শ শিক্ষায় আমার সকলেই মোটামুটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত।এজন্যে আমরা বাবা মার কাছে
আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেছি খুবই উদার, বিনয়ী এবং নম্র।
কিন্তু অন্যায়কে কখনও মেনে নেয়নি বা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। তিনি ছোট বেলা থেকে
আমাদের দিয়েছে অবাধ স্বাধীনতা এবং শিখিয়ে দিয়েছেন ভালো মন্দ বিচার করারর মুক্ত
চিন্তা চেতনা। ভালোবাসতে শিখিয়েছেন সমাজকে, গর্ব করতে শিখিয়েছেন নিজস্ব জাতীকে
নিয়ে, সুরক্ষা ও সংরক্ষন করতে শিখিয়েছেন নিজস্ব কৃষ্টি কালচার। বাবা তোমার মহান
আদর্শকে অনুসরণ করে বর্তমানে আমরা সমাজে বিভিন্ন ভাবে অবদান রাখার প্রচেষ্টায় আছি।
বাবার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া ও তার স্বপ্নকে বাস্তবে রপ দেয়ার
অপেক্ষায় আমরা সর্বদা জাগ্রত আছি, আপনারাও আমাদের সাথে থাকুন, আমার বাবার আত্না
অনেক অনেক শান্তি পাবেন।
তথ্য
সূত্রঃ মৃতঃ গজেন্দ্র মৃ (বড়ভাই)
বিঃদ্রঃ সংক্ষিপ্ততার কারনে বাবার অনেক বিষয়ে আপনাদের
জানাতে পারলামনা বলে দুখিঃত। বাবার জীবনী প্রকাশনার ইচ্ছা অচ্ছ। যদি কেউ জানার বা
আরো তথ্য প্রদান করতে আগ্রহী হোন তবে যোগাযোগ করুন মোবাইল- ০১৭০৫১৬৫৪৩৭
No comments:
Post a Comment