Saturday, March 11, 2017

জলছত্র হরিসভা মন্দিরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস





প্রবীর এন. কুমার বর্মন



প্রায় দুইশত বছর আগের কথা-মধুপুর গড়াঞ্চলের ধনড়া গ্রামের দেবেন নামে গারো যুবক হিন্দুদের দেবতা দেবাদি-দেব মহাদেবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দেবাদি-দেব মহাদেবের আরাধনা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন এবং সেই সাথে তিনি কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন। যার ফলে গারো জনগণ তার নাম দেয়দেবেন ঈশ্বর দেবেন ঈশ্বর মধুপুর গড়াঞ্চলের জলছত্র, গাছাবাড়ী ভবানীটেকী গ্রামে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। গারোদের আদি ধর্ম ছিল সাংসারেক (প্রকৃতি পূজা) সেই সাংসারেক ধর্ম থেকে তার ধর্ম প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে জলছত্র, গাছাবাড়ী ভবানীটেকী গ্রামের কিছুসংখ্যক গারো আদিবাসী জনগণ স্ব-স্ব উদ্যোগে এক এক করে হিন্দু ধর্মে ধমান্তরিত হয়ে শিষ্যত্ব লাভ করে। বাংলা ১২৭৮ সনে গারো হিন্দুদের জন্য গারো হিন্দুগণ গড়ে তোলে উপাসনালয় গাছাবাড়ী গ্রামে এবং পরবর্তী সময়ে স্থানান্তরিত হয় জলছত্র মিশনের শান্তি নিকেতনের উত্তর-পূর্বাংশে। হিন্দুদের দেবতা দেবাদি-দেব মহাদেবের আরেক নাম ছিল সোমনাথ। সেই নামের সূত্র ধরে সাপ্তাহিক উপাসনার/প্রার্থনা বার নির্ধারণ করা হয় সোমবার আর উপাসনালয়ের নাম হয় হরিসভা। বাংলা ১৩১৪ সনে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে জলছত্র নামক স্থানে উপাসনালয় হরিসভা আবারো স্থানান্তরিত করা হয়, যা আজো বিদ্যমান রয়েছে। জলছত্রের এই স্থানটি বেছে নেওয়ার পেছনে কারণ ছিল-এই স্থানে বটবৃক্ষ, অশোকবৃক্ষ, তমালবৃক্ষ, তরুবৃক্ষ ছিল বলে। বাংলা ১৩১২ সনে সিলেট থেকে আগত অম্বিকাচরণ বিশ্বাস গারো হিন্দু ভক্তদের -খুন প্রদান করে জালাচান মতাদর্শে (কৃষ্ণমতে) দীক্ষিত করে হরেকৃষ্ণ নাম ঘরে ঘরে প্রচার করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন আমলে নাটোর রাজ জমিদার জগদিন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের হুকুমে তাঁর অধীনে মধুপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নায়েব গারো হিন্দু মাতাব্বরদের গ্রেফতার করে ধরে নিয়ে বিচারের সন্মুখীন করে। সেই বিচারকার্যে উপস্থিত ছিলেন মধুপুরের শ্রী নিত্যানন্দ অনাথ সেবা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী গোপাল পাগল গোস্বামী সহ হিন্দুধর্মের ধর্মীয় পন্ডিতগণ। বিচারের কারণ/অপরাধ ছিল-কেন, কিভাবে গারোদের -খুন প্রদান করা হলো। ক্রেতাযুগে রামায়নে গারোদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়-গারোরা ছিল যোদ্ধা এবং সেই কারণে গারোরা ক্ষত্রিয় বর্ণ। এই সূত্র ধরে বিচার-বিশ্লেষণ করে বিচারের রায় প্রদান করেন। রায়ের আরো অংশ ছিল-যেহেতু গারোরা ক্ষত্রিয় বর্ণ যোদ্ধা, সেহেতু গারো হিন্দুদের উপাধি হবে দেব বর্মন, গারোদের আদি ধর্ম সাংসারেক এর প্রথাগত কিছু সামাজিক নিয়মের সাথে হিন্দুধর্ম সমাজ ব্যবস্থার সাথে ধর্মীয় সামাজিক নিয়ম সাংঘর্ষিক থাকার কারণে সে নিয়ম/আইনগুলোর আংশিক/কিছু পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন আনা হয়/করা হয়। বাংলা ১৩১৬ সনে জলছত্র হরিসভা মন্দিরের কাঠের বেড়া ঢেউটিনের ছাউনী প্রদান করেন মুক্তাগাছার জমিদার জীবন বাবু। নাটোর রাজ জমিদার জগদিন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর মুক্তাগাছার জমিদার জীবন বাবু উভয়ে মিলে পরামর্শক্রমে হরিসভার গাছাবাড়ী মৌজায় ৯৮ দাগে শতাংশ ভূমি নাখিরাজী ৯৭ দাগে .১৮ একর ১০২ দাগে কিছু জমি দেবোত্তর সম্পত্তিরূপে প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে মুক্তাগাছার জমিদার জীবন বাবুর উদ্যোগেই মানুষ ঘটপূজার পরিবর্তে মাটির তৈরি প্রতিমা দ্বারা দূর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয় হরিসভায়। পরবর্তী সময়ে বাঙ্গালী হিন্দুদের আগমন ঘটে জলছত্রে এবং তখন থেকে সহঅবস্থানে গড়ে উঠে যৌথ পূজা-পার্বণ উৎসব পালনের কাজ। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ইং সনে জলছত্র হরিসভার রাধা গোবিন্দ মন্দির পাকা ঘর নির্মাণ করা হয়। জলছত্র হরিসভাজলছত্র হরিসভা উন্নয়ন প্রকল্পনামে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃক ১৩/০৫/১৯৭৭ইং সনে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়, যার রেজিঃ নং-টম-০০৪৫। জলছত্র হরিসভা উন্নয়ন প্রকল্পের
আওতায় কুটির শিল্প মৎস্য চাষ প্রকল্প ছিল। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় জলছত্র হরিসভার তিন গম্বুজ বিশিষ্ট পাকা শিব মন্দির পাক-হানাদার বাহিনী কর্তৃৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে শিব মন্দির অন্যত্র স্থানান্তরিত করে সেই ভগ্ন মন্দির সংস্কার করে রাধা গোবিন্দ মন্দির নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে জলছত্র হরসভায় রাধা গোবিন্দ মন্দির, দূর্গা মন্দির, কালী মন্দির, শিব মন্দির নাট মন্দির রয়েছে। জলছত্র হরিসভায় এই পর্যন্ত ৮ম পুরুষ গোস্বামীর কাল অতিবাহিত হয়েছে।
বর্তমানে ৯ম পুরুষ গোস্বামীর কাল চলছে। পর্যায়ক্রমে গোস্বামীরা হলো- () শ্রী গোবিন্দ গোস্বামী () শ্রী জয় সিং গোস্বামী () শ্রী ফাল্গুন গোস্বামী () শ্রী রাজ রাজেন্দ্র গোস্বামী () শ্রী তাজিন গোস্বামী () শ্রী মনিরাম গোস্বামী () শ্রী শ্যামাচরণ গোস্বামী () শ্যী চরিত্রমোহন গোস্বামী () শ্রী সুরেন্দ্র গোস্বামী (বর্তমান চলমান) জলছত্র হরিসভা উত্তর টাঙ্গাইলের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী পুরাতন মন্দির। এই মন্দিরে স্মরণাতীতকাল থেকেই দূর্গাপূজার উৎসবকে কেন্দ্র করে পাঁচদিন ব্যাপী আনন্দ মেলা বসে। এছাড়াও মহানামযজ্ঞ অষ্টকালীন লীলাকীর্তন, কালীপূজা, শিব রাত্রী পূজাসহ অন্যন্য ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা পূজা হয়, প্রতি সপ্তাহে সোমবার কীর্তন হয়।
বি:দ্র: তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতায়: প্রবীন গারো সনাতন ভক্তবৃন্দ।