Wednesday, April 17, 2013

রেভা. ইউজিন ই. হোমরিক, সিএসসি

বাণী
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন উপলক্ষ্যে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই। এতদ্সঙ্গে এই সংগঠনের ৫০ বছর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি ‘‘স্মরণিকা’’ প্রকাশ করতে যাচ্ছে জেনে খুশী হলাম। আমি এই সংগঠনের বর্তমান এবং সাবেক সকল নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের শুভেচ্ছা, স্বাগতম এবং অভিনন্দন জানাই।
কেননা সময়ের প্রয়োজনে এই সংগঠনের নেতা ও কর্মীগণ এই এলাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রকাশ থাকে যে, হাবিমা এলাকার মান্দিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে জলছত্র ধর্মপল­ী প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর পরই আমারই পরামর্শ এবং সহযোগিতায় কতিপয় প্রগতিশীল মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিদের উদ্যোগে এই জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ গঠিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে স্বর্গীয় পরেশ মৃ অন্যতম। তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই ১৯৬২ সালের ২রা মার্চ এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাসে পিছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আমাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং উত্তরণের কথা। 
আমি ১৯৫৫ সনে ৫ই সেপ্টেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে আসি। বাংলাদেশে এসে আমি নটরডেম কলেজ, ঢাকায় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের নিকট বাংলা শিখি। বাংলা ভাষা শেখার পরই আমাকে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার গোলা ধর্মপল­ীতে পালকীয় কাজের জন্য প্রথমে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সময় আমার কর্মস্থল পর্যায়ক্রমে গোল­া ধর্মপল­ী, বিড়ুইডাকুনী ধর্মপল­ী এবং ময়মনসিংহ ধর্মপল­ীতে ছিল। আর্চ বিশপ গ্রেনার, সিএসসি আমাকে একদিন ডেকে কর্পোস খ্রীষ্টি (খ্রীষ্টদেহ ধর্মপল­ী) নামে এই হাবিমা জলছত্র গ্রামে নতুন ধর্মপল­ী স্থাপন করার জন্য বললেন। আমি ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এই হাবিমা এলাকায় আসি এবং ধর্মপল­ী প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করি। ধর্মপল­ী প্রতিষ্ঠার পর আমি দেখতে পাই এই এলাকার মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। আমি যখন এসেছি তখন বিরাট এলাকাজুড়ে বন ছিল। কিন্তু মান্দিদের জীবন যাত্রার মান ছিল খুবই নিম্ন মানের। তাই এই এলাকার মান্দিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করি এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করি। এই এলাকার মান্দিদের শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করি। স্বাস্থ্যের জন্য বিশুদ্ধ পানির নিমিত্তে বিনা মূল্যে রোয়ার পাম্প, টিউবওয়েল এর ব্যবস্থা করি, বিনামূল্যে টয়লেট ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করি এবং এর ব্যবহার পদ্ধতি শিখাই। মান্দাতা আমলের কৃষি প্রবর্তন করে আধুনিক কৃষি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং কিস্তিতে পরিশোধের জন্য অগভীর নলকূপ প্রদান করেছি। আমি যখন এসেছি তখন মান্দিদের মধ্যে শিক্ষার হার আনুমানিক ৫% ভাগ। সময়ের পরিক্রমায় আজ মান্দিদের মধ্যে শিক্ষিতের হার ৯০% ভাগ। তাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও সমাজের উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করছে।& এখন সবার বাড়ীতেই স্বাস্থ্যসম্মত রোয়ার পাম্প, টিউবয়েল এবং টয়লেট আছে। মোটামুটি সব এলাকাতেই সেচের মাধ্যমে বিভিন্ন আবাদ ফসল করছে এবং মান্দিদের স্বাস্থ্য এখন আগের চেয়ে অনেক অনেক ভাল। 
বর্তমানে মান্দিদের মূল সমস্যা হলো জমি। মান্দিদের অনেক জমি বিভিন্ন কারণে বেহাত হয়ে যাচ্ছে। সরকার অনেক রেকর্ডের জমি গেজেট নোটিফিকেশন জারি করায় মান্দিদের অনেক জমি বেহাত হয়ে যেতে পারে। তাই এই বিষয়ে তোমাদের জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। আমি এই হাবিমা এলাকায় ৫২ বছরের অধিক সময় ধরে আছি। এই সময়ের মধ্যে আমি দেখেছি যে, বিভিন্ন পরিস্থির কারণে আমাদের এই এলাকার মান্দিরা ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। আমার হিসাব মতে, আমি থাকতেই মান্দিদের ২৭টি গ্রাম শেষ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ভবিষ্যতের জন্য তোমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে। এখন থেকে ৫০ বছর আগের মান্দিদের দুঃখ দুর্দশাগুলো এখনকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে শুধুই গল্প বলেই মনে হবে। 
আমাদের এই মধুপুর এলাকায় অনেক সংগঠন আছে এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করছে। আমি জানি সংগঠনগুলো মান্দিদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু সব সংগঠনের উদ্দেশ্য লক্ষ্যগুলো এক এবং অভিন্ন। এমতাবস্থায় আমার পরামর্শ হলো; তোমরা একতাবদ্ধ হয়ে মান্দি জাতির উন্নয়নের জন্য আত্মনিয়োগ কর। পরিশেষে জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদের ‘‘সুবর্ণ জয়ন্তী’’ এর সফলতা কামনা করছি।
খ্রীষ্টেতে তোমাদেরই,
রেভা. ইউজিন ই. হোমরিক, সিএসসি
পাল পুরোহিত, সেন্ট পৌলস ধর্মপল­ী, 
পীরগাছা, মধুপুর, টাঙ্গাইল।

No comments: